মাসুদ রানা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র এক বছর। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা। যদিও এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেশের অতীত নির্বাচনের আগেও দেখা গেছে একই চিত্র। নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি তৎপরতার সঙ্গে বাড়ছে বিদেশি কূটনীতিকদের সংশ্লিষ্টতা। নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমা তৎপরতা পর্দার আড়াল থেকে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেনারেল এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরেও প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে এবং কম বেশি সব নির্বাচন ঘিরে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে বিদেশিদের তৎপরতা আলোচনায় এসেছে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হয়। ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটে নাক গলাতে শুরু করে পশ্চিমারা।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিভাজন, বিরোধী দলের সব সময় নালিশ করার প্রবণতা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের বিভক্তিসহ নানা কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলার সুযোগ পান। সরকার, সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, জনগণসহ এ দেশের অংশীজন রাজনীতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ইস্যুর সুরাহা নিজেরা করতে পারলে বিদেশিরা তাদের স্বার্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে এই ইস্যুগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপে রাখার সুযোগ আর নিতে পারবে না
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে তাদের সরব উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নানা কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অটল অবস্থান ঘোষণা করে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন ইস্যুতে সীমা লঙ্ঘন না করার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে এবং কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফল দাবি করছে।
প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে কূটনীতিকরা যতটা হস্তক্ষেপ করে, এমনটা কি বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায়? সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের মতে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলোতে সুযোগ থাকলে কথা সবাই বলবে এবং এসব কারণেই বিদেশি কূটনীতিকদের রাজনৈতিক ইস্যুতে জড়িয়ে পড়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বাংলাদেশ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই বিদেশিরা কখনোই এ সুযোগ পায় না কারণ সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
২০০৬ সালের শেষ দিকে এবং ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা দেশের কিছু কূটনৈতিক ছিলেন বেশ তৎপর। উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিসের গোপন বার্তা থেকে জানা যায়, ঢাকাস্থ পশ্চিমা কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নিজেদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করতেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কফি গ্রুপ’।
এর সাথে যুক্ত ছিল আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি। এই গ্রুপে জাপানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ২০০৭ সালের ৪ জুন দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস বলেছিলেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। এবং সেটাই হয়েছিল।
যদিও তুমুল রাজনৈতিক সংকটের জেরে বিদেশি কূটনীতিকদের আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতার ইতিহাসও আছে। ৯৬’র নির্বাচনের আগে ঢাকায় এসেছিলেন তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান। পরে ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হয়ে ঢাকায় এসে দুপক্ষকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করেছিলেন অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো। যদিও তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের পথে নিতে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগীরা। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ছাপিয়ে এ দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়েও কথা বলতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের দূতরা গত বছরের মধ্যভাগ থেকেই নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসছেন।
এ দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে দেশটি ওয়াশিংটন ও ঢাকায় সব সময়ই বাংলাদেশ ইস্যুতে কথা বলছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ছাড়াও ঢাকা সফরে আসা বাইডেন প্রশাসনের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও কর্মকর্তারাও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন।
সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ঢাকা সফরে জানিয়ে গেছেন, বাইডেন প্রশাসন কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। তারা অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে চান। ওয়াশিংটন থেকে একই বার্তা দেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। তিনি নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের এতোটা মাথাব্যথা কেন? মূলত উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের নজরে রয়েছে বাংলাদেশ। বড়-ছোট প্রভাবশালী শক্তিগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের সমর্থন পেতে চায়। আর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ভেন্ডসেন এবং সুইডিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স বার্গ ফন লিন্ডে। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস নভেম্বরে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিক্যাবের অনুষ্ঠানে চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত ও সফরে আসা বিদেশি কূটনীতিক ও অতিথিরাও প্রায় অভিন্ন এবং একই সুরে অহিংস রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছেন।
এর আগে গত জুলাই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকা মিশনের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ডজনখানেক পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত ইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে মাসেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইইউ রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক। এরপর জুলাই মাসে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং ইইউ রাষ্ট্রদূত।
সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বিএনপির সঙ্গে, জাপা চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার। এরপর বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। অক্টোবরে জাপার সঙ্গে বৈঠক করেন ইইউর ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত। সব বৈঠকেই প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল চলমান রাজনীতি ও নির্বাচন প্রাধান্য পেয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা নিয়ে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে বাদানুবাদের মধ্যে সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের আগে রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সাথে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষ ও বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানের পর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং জাতিসংঘ অফিস বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানায়।
এরপর ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের শাহীনবাগের বাসায় যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে চলে আসতে বাধ্য হন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি। পিটার হাসের এই সফর যে সরকারের পছন্দ হয়নি, সেটি পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্টও করেছেন। পিটার হাসের ওই সফরের সরাসরি সমালোচনা করেছে রাশিয়া। তার শাহীনবাগে যাওয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে জানান রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা এবং মন্তব্যে সরকার ‘বিব্রত’ বলে মনে হচ্ছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনু্ষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি আসেনি। অন্যদিকে বিরোধী দল দেখাতে চায়, বৈদেশিক শক্তিগুলো তাদের পক্ষে আছে। ডিসেম্বরের ৭ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলোকে জানিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিভাজন, বিরোধী দলের সব সময় নালিশ করার প্রবণতা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের বিভক্তিসহ নানা কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলার সুযোগ পান। সরকার, সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, জনগণসহ এ দেশের অংশীজন রাজনীতি, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ইস্যুর সুরাহা নিজেরা করতে পারলে বিদেশিরা তাদের স্বার্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে এই ইস্যুগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে চাপে রাখার সুযোগ আর নিতে পারবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।