G-X8PRCEGCWT

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কার স্বার্থে?

কলাম/ মুক্তমত
প্রকাশিত জানুয়ারি ২৮, ২০২৩
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কার স্বার্থে?

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কে পাশ কাটিয়ে সরকার নির্বাহী আদেশে পুনরায় ইউনিট প্রতি ৫ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি করেছে। ফলে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি গড় দাম বেড়েছে ৩৬ পয়সা।

গত ১৪ বছরে এ নিয়ে ১১ বারের মতো বৃদ্ধি পেলো বিদ্যুতের খুচরা দাম। এই মূল্যবৃদ্ধি জানুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হবে। এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ১০ম বারের মতো দেশে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বিইআরসি, যা গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।

সরকার জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ/সীমিত করে সৌরশক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রাষ্ট্রীয় অপচয় বন্ধ করা জরুরি। সব দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার সেটাই করেছে।

খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে গত ডিসেম্বর মাসে আবেদন করে দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি করার ব্যবস্থা করতো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে সরকার দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিতে অধ্যাদেশ জারি করে, যা সংসদের চলতি অধিবেশনের প্রথম দিনেই উত্থাপিত হয়।

অধ্যাদেশ অনুসারে সরকার বিশেষ পরিস্থিতিতে গণশুনানি ছাড়াই মূল্যবৃদ্ধি করতে পারবে। এরপর গত ১২ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো সরকার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে মূল্যবৃদ্ধি করে। গণশুনানি না করে একতরফা ভাবে দাম বাড়ানোর ফলে দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা আর থাকলো না বলেই মনে করা হচ্ছে।

শুনানি হলে মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, দুর্নীতি, অনিয়ম ও কোম্পানির অদক্ষতার বিষয় সামনে আসে। পেট্রোবাংলা এর আগে গ্যাসের দাম বাড়াতে বাড়তি এলএনজি আমদানি তথ্য দিয়েছিল সেটি শুনানির সময় ধরা পড়ে।

বিইআরসি শুনানির ক্ষেত্রে সময় কমানো যেতে পারতো তবে এটা কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ালে বাজারে মনোপলি তৈরি হতে পারে, এতে কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিতে পারে। অদক্ষতা আরও বাড়তে পারে। তাই অবশ্যই বিইআরসির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত ছিল। বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর ফলে বাজারে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবু দেখা যাবে সব জিনিসের দাম বেড়েছে।

আমাদের দেশে ৫ টাকা দাম বাড়লে বাজারে জিনিসপত্রের দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা পুরোনো। জ্বালানি তেলের দাম ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়া ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে ও ভোক্তা পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। শক্ত হাতে সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে বিতরণ সংস্থার কাছে ৬ টাকা ২০ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে। ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা প্রতি ইউনিটে বিক্রি করে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে এখন থেকে ভোক্তাকে ইউনিটপ্রতি গড়ে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা গুনতে হবে। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চ মাসে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি করেছিল বিইআরসি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের জন্য এটা বাড়তি বোঝা হিসেবে দেখা দেবে। এছাড়া বিদ্যুতের দাম বাড়ায় নতুন করে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। এর আগে গত বছরের জুন মাসে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়।

ফলে ভোক্তাকে বাসার রান্নায় ব্যবহৃত দুই চুলার জন্য মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা, এক চুলার জন্য দিতে হচ্ছে ৯৯০ টাকা। আর প্রিপেইড গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য (ঘনমিটার) ১৮ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে ভোক্তা পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। এদিকে গত আগস্ট মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৪৩ টাকা অকটেনের দাম ৪৬ টাকা এবং পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়।

অবশ্য মাসের শেষ দিকে সরকার ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমিয়ে দেয়। কিন্তু এর কোনো প্রভাব বাজারে দৃশ্যমান হয়নি। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে গত জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লোডশেডিং শুরু করেছে সরকার। নভেম্বরে শীত শুরুর আগ পর্যন্ত এটি চলমান থাকে।

এরপর শীতের মধ্যেও গত ৪ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। এখন দাম বাড়ানোর পর আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা সরকার দিতে পারছে কি না সেটাই দেখার বিষয়। তবে সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আশাবাদী হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

মূলত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। দেশে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে শিল্প-কলকারখানা সব জায়গায়ই কমবেশি বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। ফলে সব খাতে এই মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।

আমদানিতে টাকার মান পড়ে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সত্যিকার অর্থেই ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন আগেও আমরা শুনেছিলাম শীতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, দেশবাসী তাতে আশ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি তো হয়ইনি বরং শীতকালেও ক্ষেত্রবিশেষে লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে দেশের শিল্প-কারখানা শনিবার বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। ফলে শিল্পমালিকরা বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডিজেল কিনে জেনারেটর ব্যবহার করে তাদের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিল। এতে উৎপাদন খরচ অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।

এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে সব ধরনের শিল্প মালিকরা কমবেশি ডলার সংকটে ভুগছেন। ডলার সংকটের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে এ খাতে ভর্তুকি বাড়ালে আরও ভালো হতো। মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্যের দাম বাড়বে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, এতে করে ব্যবসায় এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন বিদ্যুতের বিল বাড়বে, অন্যদিকে বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়বে যেমন কৃষিকাজে সেচের ব্যয় বাড়বে, কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে, এর সঙ্গে দোকানের বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে, কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, সাধারণত দেখা যায় যে, দিনশেষে ব্যয়বৃদ্ধির বড় একটি অংশ ভোক্তাদের ওপরই চাপানো হয়। বিদ্যুৎ খাতে সরকার বড় অংকের ভর্তুকি দেয় সত্য, মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় হয়তো কিছুটা কমবে কিন্তু বড় ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে না।

মনে করা হচ্ছে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সরকার যে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের কথা বলেছিল তার অংশ হিসেবেই এটা করা হয়েছে। তবে মূল্যবৃদ্ধি না করেও তা অন্যভাবে করা যেতে পারতো। মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার নিশ্চয়তা সরকার দিতে পারছে না।

দেশের সামগ্রিক ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও বিদ্যুৎ খাতের অদক্ষতা হ্রাস পায়নি, দক্ষতা বাড়েনি, দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎউৎপাদন কেন্দ্র, অদক্ষ ও ত্রুটিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন, এসব সমস্যার সমাধান না করে ভোক্তার ওপর একতরফাভাবে দায় চাপানো হলো।

আরেকটি বিষয় হলো ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকার একটি বড় অংশ এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও কিছু ব্যবসায়ী ভোগ করছে। যেসব কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি পাচ্ছে সেগুলো আমলে নেওয়া জরুরি। জ্বালানি নির্ভরশীল বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে এসে সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নবায়নযোগ্য এনার্জির যুগে দ্রুত প্রবেশ করার উদ্যোগ জরুরি ছিল। এই পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত।

সরকার জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ/ সীমিত করে সৌরশক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রাষ্ট্রীয় অপচয় বন্ধ করা জরুরি। সব দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার সেটাই করেছে।

লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন