এ’তেকাফের অবিধানিক অর্থ হল আবদ্ধ করা, নিয়ন্ত্রণ করা বা জমিয়ে বসা। শরিয়তের প্রচলিত অর্থে দুনিয়াদারি, কাজকর্ম, ব্যস্ততা, সম্পর্ক ইত্যাদি ত্যাগ করে এবাদতের উদ্দেশ্যে খোদার ঘর মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখাকেই এ’তেকাফ বলা হয়।
এ’তেকাফের ফজিলত :
ক) এ’তেকাফ এত মর্যাদাপূর্ণ এবাদত যে ইসলামী আইনবিদ, ফকীহরা মু’তাকিফা (এ’তেকাফকারী)-কে আল্লাহর প্রতিবেশী বান্দা বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ আছে, ‘কে আছে জগতে এমন ব্যক্তি যে খোদার প্রতিবেশী হতে পারে? সে আর কেউ নয়, সে ওই মসজিদে বসে থাকা মু’তাকিফ। সে-ই খোদার পড়শি. তাঁর দোস্ত।’ খ) নবিজি বলেছেন, মুতাকিফ যে শুধু পবিত্র স্থান মসজিদে বসে থাকার সওয়াব লাভ করে তা নয়, সে একদিকে বাইরের জগতের সব ধরণের পাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। অন্যদিকে এ’তেকাফের দরুন বাইরের জগতের যেসব নেক কাজে সে অংশীদার হতে পারছে না সেসব পুণ্যকর্মের বদলা তাকে মুফত প্রদান করা হয়। গ) অন্য একটি হাদিসে হুজুরের ফরমান রয়েছে, যে জন খোদার সন্তুষ্টি লাভের আশায় মাত্র একদিনের জন্য এ’তেকাফে থাকবে, আল্লাহপাক তার এবং দোযখের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। এক একটি খন্দকের গভীরতা হল আসমান ও জমীনের মধ্যাকার দূরত্বের সমান। ভেবে দেখুন, সে কি দোজখের আঁচ পাবে? ঘ) আরো একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ দশদিন এ’তেকাফ করবে তাকে মকবুল দুই হজ্ব ও দুই উমরার সওয়াব প্রদান করা হবে।
এ’তেকাফের গুরুত্ব :
ক) এ’তেকাফ অতি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। এর দ্বারা শবেকদর লাভ করা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, যার মর্যাদা হাজার মাসের এবাদতের মর্যাদা থেকেও বেশি। খ) জাগতিক ঝামেলামুক্ত হয়ে কিছুদিন একাগ্র চিত্তে খোদার এবাদত ও তাঁর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। গ) মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করে গোরস্থানে একাকী থাকতে হবে। এ’তেকাফ তারই ট্রেনিং সরূপ।ঘ) ইসলামী পন্ডিতদের পরামর্শ হল, মস্তিস্কে বিকার থাকা ব্যক্তিকে এ’তেকাফে বসিয়ে রাখতে পারলে তা রোগমুক্তির জন্য সহায়ক হবে। ঙ) আমাদের প্রিয় নবী (দঃ) এ’তেকাফের হুকুম পাওয়ার পর থেকে কোনো বছরই এ’তেকাফ ছাড়েননি। এ’তেকাফের গুরুত্ব আছে বলেই তিনি এরূপ করেছেন। চ) কম সময়ে ও অল্প শ্রমে বেশি সওয়াব উপার্জনের উপায় হল এ’তেকাফ। আফসোস, এতকিছুর পরও এ’তেকাফকারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। মুতাকিফদের শতকরা হার বের করা মুশকিল। হাজারের মধ্যেও একজন পাওয়া কি সম্ভব হবে?
এ’তেকাফের স্থান :
মহল্লার জামাতওয়ালি মসজিদে এ’তেকাফ করতে হবে। স্ত্রীলোকেরা বাসস্থানের কোনো নির্দিষ্ট কামরায় বা ঘরের কোনায় এ’তেকাফে বসতে পারেন। এটাই তাদের জন্য মসজিদে জামাত বলে শরিয়তের ঘোষণা।
এ’তেকাফের হুকুম:
এ’তেকাফ সুন্নত মুআক্কাদাঃ কেফায়া ঃ অর্থাৎ মহল্লার যে-কোনো ব্যক্তি এ’তেকাফ করে নিলে গ্রামবাসীর ওই সুন্নত মুআক্কাদাঃ পালনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি লাভ করবে। কিন্ত কেউই এ’তেকাফে না বসলে সকল গ্রামবাসীই গুনাহগার হবেন।
কখন থেকে এ’তেকাফ আরম্ভ হয় :
রমজানের সুন্নত অনুযায়ী এ’তেকাফের জন্য বিশ (২০) রমজান সূর্যাস্তের আগে আগেই মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। অবশ্য নফল এ’তেকাফের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল এ’তেকাফের নিয়ত করে নিতে পারে। নিয়ত ছাড়া কিন্তু এ’তেকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে না। এটা একটি ক্ষণস্থায়ী পূণ্যময় এবাদত।
এ’তেকাফের সময় কোন কোন কাজের জন্য মসজিদের বাহিরে যাওয়া চলবে :
ক) প্রস্্রাব, পায়খানা, ওজু, ফরজ গোসলের জন্য মসজিদের বাহিরে যাওয়া যাবে। খ) এ’তেকাফকারী মসজিদে থাকলে প্রাণনাশের ভয় হলে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বের হয়ে নিকটস্থ কোনো মসজিদে গিয়ে এ’তেকাফে বসবে। গ) আহারাদি জোগান দেওয়ার মানুষ না-থাকলে মুতাকিফ নিজে ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় আহারাদি নিয়ে আসতে পারবেন। তবে রাস্তায় বা বাসস্থানে দেরি করতে পারবেন না। অযথা দেরি করলে এ’তেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।
আজকের যুগে আহারাদি আগে থেকে জোগাড় করে রাখার বিভিন্ন পন্থা-পদ্ধতি রয়েছে। উন্নত ধরনের হটকেস্-এ খাদ্যবস্তু, আহারাদি ১০/১২ ঘন্টা গরম রাখা যায়। সুতরাং মুতাকিফ ইচ্ছা করলে হটকেস্ এর মাধ্যমে দিনের বেলাই রাতের আহারাদি সংগ্রহ করে নিতে পারেন। দিনের বেলায় অন্যের সাহায্য পাওয়াও সহজ।
কোন কোন কারণে এ’তেকাফ বাতিল হয় :
ক) শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া এক মুহূর্তকাল মসজিদের বাইরে থাকলে এতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে। খ) রোজা ভেঙ্গে গেলে সঙ্গে সঙ্গে এতকাফও নষ্ট হয়ে যায়। গ) দীর্ঘসময় বেহুশ হয়ে থাকলে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যায়। ঘ) এ’তেকাফের অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে এ’তেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। ঙ) স্ত্রীলোক এ’তেকাফে বসার পর নেফাছ বা মাসিক রোগ দেখা দিলে এ’তেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।
এ’তেকাফের মকরূহসমূহ :
ক) চুপ করে থাকা এবাদত মনে করে নির্বাক হয়ে থাকা মকরূহ। খ) অযথা বেশি কথা বলাও মকরূহ। গ) জিনিসপত্র মসজিদে হাজির করে ক্রয়-বিক্রয় করা মকরূহ। ঘ) মসজিদের ভিতরে বিড়ি, সিগারেট পান করা মকরূহ। ধূমপানের প্রতি বেশি আসক্ত হলে প্রস্রাব, পায়খানায় যাওয়ার পথে ধূমপান সেরে নেবেন, (ফতাওয়ার রশিদীয়া), তবে মুখে দুর্গন্ধ দূরীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এই সুযোগে ধূমপানের যত বদ অভ্যাস বর্জন করা উচিৎ। এই দৃঢ় সদিচ্ছা এই বদ অভ্যাস পরিহারে যথেষ্ট।- আসুন, আমরা সময় করে এ’তেকাফ করি এবং অশেষ সওয়াব ও মহানর আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি।লেখক- সাংবাদিক কলামিস্ট।