পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ইমরান খান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সর্বাধিক আসনে জয় পাওয়া দেশটির চিরাচরিত রাজনৈতিক পূর্বাভাসকে পাল্টে দিয়েছে। প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া নেতাদের পাকিস্তানে নির্বাচনি সাফল্য পাওয়া বিরল ঘটনা।
কারাবন্দি ইমরানের সমর্থকরা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সমর্থন পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এতে দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।
পরবর্তী সরকারের কী হবে?
বেশ কিছু আসনে নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাচ্ছেন ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভোট গণনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ স্বীকার করার জন্য পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ওপরও চাপ বাড়ছে।
রবিবার দুপুর পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবারের ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেনি। বেসরকারি ফল অনুসারে, ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯২টি আসনে জয়ী হয়েছেন। তবে কয়েকটি পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে এই সংখ্যা ১০১ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) জয়ী হয়েছে ৭৭ আসনে। আর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৫৪টি আসন।
৩৩৬ আসনের জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে অন্তত ১৬৯টি আসনের প্রয়োজন। পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে, ভোটের ২১ দিনের মধ্যে পার্লামেন্টের নেতা ও পরে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য অধিবেশন আহ্বান করতে হবে।
ইমরান সমর্থিত প্রার্থীরা পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায় নতুন সরকার গঠনে নানা সমীকরণ ও তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
নওয়াজ শরিফের দল পিএমএলএন পিপিপি ও ছোট মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)-এর সঙ্গে জোট গঠন করে সরকার গঠনের দায়িত্ব নিতে চাইছে। এমকিউএম এবার ১৭টি আসনে জয় পেয়েছে। সরকার গঠনে নওয়াজের সামনে আরেকটি পথ রয়েছে। আর তা হচ্ছে, পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দলে ভিড়ানো, যাতে পিপিপির সঙ্গে তার দলের জোট গঠন করতে না হয়।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পিএমএল-এন দলের আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু নিশ্চিত নয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারা বিপুল জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে বিরোধিতা করা জোটের নেতা কে হবেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ একজন গ্রহণযোগ্য নেতা। ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরানকে উৎখাতের পর একই ধরনের জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর কাছে নওয়াজের চেয়ে শাহবাজ বেশি পছন্দের। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন নওয়াজ। বৃহস্পতিবার তিনি একটি আসনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু খান সমর্থিতরা ফলাফলে কারসাজির অভিযোগ করেছেন।
ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র বিজয়ী প্রার্থীরাও একটি জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করবেন। যদিও তাদের সম্ভবত সেনাবাহিনীর বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে। মনে করা হয়, সেনাবাহিনী পিএমএলএন-পিপিপি জোট পছন্দ করে। ইমরানের দল নির্বাচনে না থাকায় তাদের প্রতি সমর্থন আছে এমন একটি দলে স্বতন্ত্র জয়ীদের যোগদান করতে হবে।
কী করবে সেনাবাহিনী?
নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনগণের অবস্থান সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের ওপর নিশ্চিতভাবে চাপ তৈরি করবে।
সেনাপ্রধানকে এখন অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইমরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা বা দ্বিধা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া এবং খানবিরোধী রাজনীতিকদের একটি জোট গঠনে বাধ্য করা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন জোট সরকার হবে দুর্বল এবং টেকসই হবে না।
শনিবার এক বিবৃতিতে জেনারেল মুনির ঐক্য ও স্বাভাবিকতার ডাক দিয়েছেন। অনেকে তার এই বক্তব্যকে ইমরান খানের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুতির ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিচ্ছেন।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারওয়া আমের বলেছেন, সেনাপ্রধান যে পথ বেছে নেন না কেন, প্রভাবশালী সেনাবাহিনী হয়তো জনসমর্থন হারাবে।
সামরিক কাঠামোর জন্য জন্য ইমরান খানকে কারাগারে রাখা কঠিন কাজ হবে। ভোটে তার রাজনৈতিক বিজয়ে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে চাপ বাড়বে। বিশেষ করে যেসব মামলায় ভোটের আগমুহূর্তে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শনিবার ইমরানকে বেশ কয়েকটি মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা রয়েছে সেনাবাহিনীর স্থাপনায় তার সমর্থকদের হামলার ঘটনায়। কিন্তু এখনও অন্যান্য মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কয়েক দশক কারাদণ্ডের মুখে রয়েছেন।
কয়েকজন বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৮৮ সালের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওই সময় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরোধিতা মোকাবিলা করে বেনজির ভুট্টো নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।
মার্কিন চাপে অনিচ্ছায় বেনজির ভুট্টোকে সরকার গঠন করতে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্রনীতি বা দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রনীতিতে তার কথা বলার কোনও এখতিয়ার ছিল না।
শেষ পর্যন্ত তিনি পুরো মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তার সরকার উৎখাত হয়।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস