প্রথম তারাবীহতে পঠিতব্য কুরআনের প্রথম দেড় পারা জুড়ে আছে সূরা ফাতিহা ও সূরা বাকারার প্রথমার্ধ।
সূরা ফাতিহা :
সূরা ফাতিহা কুরআনের সবচেয়ে মহিমান্বিত সূরাগুলোর একটি। এ জন্য হাদীসে এটিকে উম্মুল কুরআন বা কুরআনের মূল[১] বলা হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত বিষয় নিবেদন করার আগে আল্লাহর গুণকীর্তন ও প্রশংসা করতে হয়, এই সূরায় সেটি শেখানো হয়েছে। এই সূরার মূল বিষয় তিনটি।
এক. মহান আল্লাহর প্রশংসা। দুই. ইবাদত-দাসত্ব ও প্রার্থনা কেবল আল্লাহর জন্যই নিবেদিত, তার স্বীকারোক্তি। তিন. হেদায়েত বা সরল-সঠিক পথের নির্দেশ এবং আল্লাহর ক্রোধের পাত্র ও পথভ্রষ্টদের পথ থেকে আত্মরক্ষার প্রার্থনা। হেদায়েত মুমিনের জীবনে এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিদিন ফরয সালাতে কম পক্ষে সতেরো বার সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে হেদায়েত কামনা করতে হয়।
সূরা বাকারা :
সূরা বাকারা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা। এ সূরার শুরুতে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, এই গ্রন্থের প্রতিটি বিষয় সন্দেহাতীতভাবে সত্য। এটি মুত্তাকীদের পথপ্রদর্শক। এরপর মানুষকে মুত্তাকী, কাফির ও মুনাফিক—এই তিন ভাগে ভাগ করে তাদের বৈশিষ্ট্য এবং পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকে দান করে এবং আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনে ও আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে—তারা মুত্তাকী এবং তারা আল্লাহর পক্ষ হতে হেদায়েতপ্রাপ্ত ও প্রকৃত সফল। কুরআন তাদেরকে পথ দেখাবে। আর জেদী ও হঠকারী কাফিরদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন। তাদেরকে সতর্ক করা হলেও তারা সতর্ক হবে না। মুনাফিকদের কার্যকলাপ ভয়াবহ ও সূক্ষ্ম হওয়ার কারণে তাদের বিষয়ে দীর্ঘ পরিসরে আলোকপাত করা হয়েছে। ২/৩-২০
ঘটনাবলি :
আজকের তিলাওয়াতকৃত অংশের শুরুর দিকে রয়েছে প্রথম মানব আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অহংকারবশত তাকে সম্মান জানাতে ইবলিসের অস্বীকৃতি, আদম ও হাওয়ার জান্নাতে প্রবেশ ও শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে জান্নাত থেকে বের হওয়া ও আল্লাহর শেখানো তাওবার দোয়া পাঠ করে ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার বিবরণ। এটি কুরআনে বর্ণিত প্রথম ঘটনা। ২/৩০-৩৯
এরপর ফিরাউনের জুলুম থেকে রক্ষাসহ বনী ইসরাইলের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য বিশেষ অনুগ্রহের উল্লেখ এবং এতদসত্ত্বেও তাদের হঠকারিতা ও অবাধ্যতার ইতিহাস উঠে এসেছে। ২/৪০-৬৬
তারপর রয়েছে গাভীর ঘটনা। সূরাতুল বাকারা মানে গাভীর বিবরণ সংক্রান্ত সূরা। বনী ইসরাইলের এক খুনীকে অলৌকিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য তারা তাদের নবীর নিকট আবেদন করে। মহান আল্লাহ তাদেরকে একটি গাভী জবাইয়ের নির্দেশ দেন। তারা তা পালনে গড়িমসি ও কালক্ষেপণ করতে থাকে। অবান্তর প্রশ্ন করে সরল বিষয়কে আরো জটিল করে তোলে। এই সূরায় বনী ইসরাইলের কূটচরিত্রের উল্লেখের পাশাপাশি শেষের দিকে মুমিনদের আনুগত্যের প্রসংশা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ঈমানদারগণ যেভাবে আল্লাহর নির্দেশ পায়, সেভাবেই মান্য করে। তারা বনী ইসরাইলের মতো আল্লাহর নির্দেশ মানতে গড়িমসি ও বিলম্ব করে না। ২/৬৭-৭৩
সুলাইমান (আ.)-এর যুগে বাবেল শহরে হারুত মারুত নামে দুজন ফেরেশতা আগমন করেন। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে বাবেলবাসীকে পরীক্ষামূলক জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতেন এবং জাদুর ক্ষতি হাতে-কলমে দেখিয়ে তা থেকে সতর্ক করতেন। অথচ বাবেলবাসী ফেরেশতাদ্বয়ের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ না করে বরং জাদুর চর্চা করে ভয়ংকর কুফুরীতে লিপ্ত হয়। তাদের পাপ এমন, এর ফলে আখিরাতে তাদের কোনো উত্তম বিনিময় থাকবে না। আলোচ্য সূরায় এই ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। ২/১০২-১০৩ এরপর ইবরাহীম ও ইসমাইল (আ.) কর্তৃক কাবার ভিত্তি স্থাপনের ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। সে সময় তারা আল্লাহর নিকট কয়েকটি চমৎকার দোয়া করেছিলেন, আমাদের শিক্ষার জন্য সেই দোয়াগুলোও আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। ২/১২৭-১২৯
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল বাইতুল মাকদিস। মাক্কি জীবনে মুসলমানদের প্রতি বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে সালাত আদায়ের নির্দেশ ছিল। মদীনায় আসার পরও সতের মাস সে নির্দেশ বহাল ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে বাইতুল মাকদিসের পরিবর্তে বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন আল্লাহ। ২/১৪২
আদেশ :
■ আল্লাহর ইবাদত করা। ২/২১
■ অঙ্গীকার পূর্ণ করা। ২/৪০
কুরআনের প্রতি ঈমান আনা এবং একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা। ২/৪১
■ সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা এবং জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় করা। ২/৪৩
■ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। ২/৪৫, ১৫৩ ■ পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয় ও এতিম-মিসকীনের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং মানুষকে উত্তম কথা বলা। ২/৮৩
■ (হজ ও উমরার সময়) মাকামে ইবরাহীমে সালাত আদায় করা। ২/১২৫
বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা। ২/১৪৯
আল্লাহকে স্মরণ করা এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। ২/১৫২
■ জিহাদ করা। ২/১৯৩
আল্লাহর রাস্তায় দান সাদাকা করা এবং মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা। ২/১৯৫ ■ (সামর্থ্য থাকলে) হজ উমরা করা। ২/১৯৬
■ ইস্তিগফার করা। ২/১৯৯
নিষেধ :
■ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করা। ২/২২
কুরআনকে অস্বীকার না করা এবং আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে পার্থিব স্বার্থ গ্রহণ না করা। ২/৪১
■ সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত না করা এবং সত্য গোপন না করা। ২/৪২
■ পরস্পরে রক্তপাত না করা এবং কাউকে তার ভিটা থেকে বিতাড়ন না করা।
২/০৮
■ সন্দেহপোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। ২/১৪৭
আল্লাহর অকৃতজ্ঞ না হওয়া। ২/১৫২
■ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করা। ২/১৬৮
অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভক্ষণ না করা। ২/১৮৮ ■ নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন না করা। ২/১৯৫
দৃষ্টান্ত :
সুবিধাবাদী মুনাফিকদের দুটি দৃষ্টান্ত বিবৃত হয়েছে। প্রথম দৃষ্টান্তে তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ আলো লাভ করার পর আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে তাদেরকে ঝড়ো রাতে পথচলা এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে কখনো বিজলির আলোতে পথ চলে, আবার কখনো থেমে যায়। প্রথম দৃষ্টান্তটি সে সকল মুনাফিকের, যারা ইসলামের সত্যতা সুস্পষ্ট হওয়ার পরও বুঝে-শুনে কুফর অবলম্বন করেছিল। আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি সে সকল মুনাফিকের, যারা ইসলামগ্রহণের ব্যাপারে দ্যোদুল্যমানতায় ভুগছিল। ফলে দলিল-প্রমাণ সামনে আসলে তারা ইসলামের দিকে ধাবিত হতো। আবার পার্থিব স্বার্থের কারণে কুফরের দিকে ঝুঁকত। ২/১৭-২০
বিধি-বিধান :
১. হজ ও উমরাহকারীদের জন্য সাফা ও মারওয়া সায়ী করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ২/১৫৮
২. সাম্যের অনন্য দৃষ্টান্ত কিসাসের বিধান ফরয করা হয়েছে। ২/১৭৮
৩. রমাদানে সিয়াম পালন ফরয। সে মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে এবং মুসাফির ও (সিয়ামে অপারগ) রুগ্ন ব্যক্তি পরে সিয়াম রাখতে পারবে। ২/১৮৩-১৮৫, ১৮৭
হালাল-হারাম :
দ্বিতীয় পারার প্রথমার্ধে হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মৃত প্রাণী, শূকর ও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করা প্রাণীর মাংস হারাম করা হয়েছে।
সুসংবাদ :
যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে একাধিক আয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। ২/২৫
বিপদাপদে সালাত ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনাকারী ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিয়েছেন মহান আল্লাহ। ২/১৫৩, ১৫৫, ১৫৬
চ্যালেঞ্জ :
কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ কিতাব, এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকলে কুরআনের মতো নির্ভুল, অলৌকিক গুণসম্পন্ন একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ আল্লাহ ঘোষণা করেছেন। ২/২৩
আজকের শিক্ষা :
আমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাহ হিসেবে পাঠানো হয়েছে। তাই আমাদেরকে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। কঠোরতা, গোঁড়ামি, বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন কোনো অবস্থাতেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের বৈশিষ্ট্য নয়। ২/১৪৩ আল্লাহর অবাধ্য হলে যে কোনো সময় সরাসরি আল্লাহর গজব নিপতিত হতে পারে। তাই সর্বদা আল্লাহর বিধান মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। ২/৯০
বিপদাপদে ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি বলতে হবে : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। অর্থাৎ নিশ্চয় আমরা আল্লাহর এবং তার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। ২/১৫৬
আজকের দোয়া :
رَبَّنَا تَقَبَّلُ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। ২/১২৭
ربَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَ فِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে দান করো দুনিয়ায়ও কল্যাণ ও আখিরাতেও কল্যাণ এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করো। ২/২০১
[১] দ্রষ্টব্য : সহিহ বুখারি, ৭৭২; সহিহ মুসলিম, ৩৯৪; সুনানে আবু দাউদ, ১৪৫৭; সুনানুত তিরমিযি, ৩১২৪; সুনানুদ দারিমি, ৩৪১৭