G-X8PRCEGCWT

২য় তারাবীতে তেলাওয়াতকৃত সুরার শানে নুযুল, আদেশ-নিষেধ ও সুসংবাদ

শায়খ আহমাদুল্লাহ
প্রকাশিত মার্চ ১২, ২০২৪
২য় তারাবীতে তেলাওয়াতকৃত সুরার শানে নুযুল, আদেশ-নিষেধ ও সুসংবাদ

দ্বিতীয় তারাবীহর পঠিতব্য অংশ হলো কুরআনের দ্বিতীয় পারার শেষার্ধ ও পুরো তৃতীয় পারা। আজকের তিলাওয়াতে সূরা বাকারার শেষাংশ ও সূরা আলে ইমরানের প্রথমাংশ থাকবে।

ঘটনাবলি :
বনী ইসরাইলের কিছু লোক অত্যাচারী জালুতের জুলুম থেকে মুক্তির আশায় সে সময়ের নবীর কাছে একজন শাসক কামনা করে, যেন তার নেতৃত্বে তারা যুদ্ধ করতে পারে। আল্লাহ তালুতকে তাদের নেতা মনোনীত করে তার নেতৃত্বে যুদ্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু অল্প লোক ব্যতীত অধিকাংশই যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। মহান আল্লাহ দৃঢ়পদ, ধৈর্যশীল এবং অনুগতদের জালুতের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেন। ২/২৪৬-২৫১

জীবন-মৃত্যুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে পুনরায় জীবিত করবেন। যিনি শূন্য থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যু-পরবর্তী পুনরুত্থান তার জন্য কঠিন কিছু নয়। আজকের তারাবীহতে চারটি ঘটনার মাধ্যমে সেটি তুলে ধরা হয়েছে।

এক. যুদ্ধ কিংবা মহামারীতে মৃত্যুর ভয়ে পলায়ন করা নিষেধ। বনী ইসরাইলের কয়েক হাজার লোক মৃত্যুভয়ে আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল। এই কৃতকর্মের শাস্তি-স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে মৃত্যু দিয়ে পুনরায় জীবিত করেন এবং স্বাভাবিক জীবনের সুযোগ দেন; যেন তারা তাওবা ও শিক্ষা অর্জন করতে পারে। ২/২৪৩

দুই. অহংকারী নমরুদ নিজেকে স্রষ্টা এবং জীবন-মৃত্যুর মালিক দাবি করে শিশুসুলভ যুক্তি পেশ করায় ইবরাহীম (আ.) পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাকে নিরুত্তর ও হতভম্ব করে দেন। ২/২৫৮

তিন. উজায়ের (আ.) আল্লাহর কাছে জানতে চান, কীভাবে তিনি মানুষকে মৃত্যুর পর জীবিত করবেন। আল্লাহ চাক্ষুস প্রমাণের জন্য তাকে মৃত্যু দিয়ে একশ বছর পর পুনরায় জীবিত করেন। ২/২৫৯

চার. পূর্ণ ঈমানের পরও শুধু কৌতূহলবশত একই প্রশ্ন করেছিলেন ইবরাহীম (আ.)। আল্লাহ তাকে চারটি পাখি টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে আসতে বলেন। এরপর আল্লাহ পাখিগুলোকে জীবিত করেন। ২/২৬০

সূরা আলে ইমরান :
আলে ইমরান মানে ইমরানের বংশধর। ইমরান ঈসা (আ.)-এর নানা। এই সূরায় ঈসা (আ.)-এর অলৌকিকভাবে জন্ম, তার মুজিযা, মা মারইয়ামের সচ্চরিত্র, মারইয়াম গর্ভে থাকাকালীন তার মায়ের (ঈসার নানি) মানত ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি উল্লেখ করা হয়েছে, সেজন্য এই সূরার নাম আলে ইমরান।
পাশাপাশি বার্ধক্যে যাকারিয়া (আ.)-এর সন্তান প্রার্থনা এবং সেই প্রেক্ষিতে সন্তান হিসেবে ইয়াহইয়াকে দান করার ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে। ৩/৩৮-৪১

দৃষ্টান্ত :
আল্লাহর রাস্তায় দানকে এমন একটি বীজের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায় এবং প্রত্যেকটি শীষে থাকে একশটি দানা। অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় এক টাকা দান করলে তা সাতশ গুণ বর্ধিত হয় এবং এক টাকায় সাতশ টাকা দানের সওয়াব পাওয়া যায়। ২/২৬১

লোকদেখানো দানকে সেই মসৃণ পাথরের সাথে তুলনা করা হয়েছে; যার উপর কিছু মাটি জমে ছিল। অতঃপর প্রবল বর্ষণে সব মাটি ধুয়ে যায় এবং এককণা মাটিও অবশিষ্ট থাকে না। তেমনি রিয়ামিশ্রিত দানের সওয়াব ও বিনিময় বৃষ্টিধোয়া মাটিশূন্য পাথরের মতো হয়ে যায়। ফলে কোনো সওয়াব অবশিষ্ট থাকে না। ২/২৬৪

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান-সাদাকার দৃষ্টান্ত হলো, উঁচু টিলায় অবস্থিত বিশাল বাগানের মতো, যাতে সামান্য বৃষ্টি হলেও ফসল ফলে আর প্রবল বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফসল উৎপন্ন হয়। একইভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান-সাদাকা করলে আল্লাহর নিকট তার বিনিময় পাওয়া যায়, অল্প হোক কিংবা বেশি। ২/২৬৫

কিয়ামতের দিন সুদখোরদের অবস্থা হবে শয়তানের স্পর্শে মাতাল হওয়া মানুষের মতো। ২/২৭৫

আল্লাহ ঈসা (আ.)-এর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন আদম (আ.)-এর সাথে। উভয়কে তিনি পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। পার্থক্য শুধু আদমকে পিতামাতা ছাড়া আর ঈসাকে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। ৩/৫৯

আদেশ :
■ ঋতু অবস্থায় স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। ২/২২২
■ আল্লাহকে ভয় করা। ২/২২৩
■ আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করা। ২/২৩১
■ সালাতসমূহের প্রতি যত্নশীল হওয়া; বিশেষ করে আসরের সালাত। ২/২৩৮ আল্লাহর সামনে অর্থাৎ সালাতে বিনয়ের সাথে দাঁড়ানো। ২/২৩৮
■ আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা। ২/২৪৪
■ আল্লাহর জন্য ব্যয় করা। ২/২৫৪
■ আল্লাহর পথে উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা। ২/২৬৭
■ সুদভিত্তিক লেনদেন পরিহার করা। ২/২৭৮
■ সেদিনকে ভয় করা যেদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং প্রত্যেকে কর্মফল বুঝে পাবে। ২/২৮১
■ ঋণ আদান-প্রদানের সময় লিপিবদ্ধ করা এবং দুজন সাক্ষী রাখা। ২/২৮২ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা। ৩/৩২
■ আল্লাহকে অধিক স্মরণ করা এবং সকল-সন্ধ্যায় তার মহিমা ঘোষণা করা।
৩/৪১
■ আল্লাহর ইবাদত করা। ৩/৫১

নিষেধ :
■ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করা। ২/২০৮
■ মুশরিকদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া। ২/২২১
■ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করা। ২/২২৯
■ আল্লাহর আয়াতকে তামাশার বস্তু না বানানো এবং জুলুমের উদ্দেশ্যে কাউকে স্ত্রী হিসেবে আটকে না রাখা। ২/২৩১
■ খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে দান-সাদাকা বরবাদ না করা। ২/২৬৪
■ আল্লাহর পথে ব্যয়ের সময় মন্দ জিনিস না দেওয়া। ২/২৬৭
■ সাক্ষ্য গোপন না করা। ২/২৮৩
■ কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ৩/২৮

বিধি-বিধান :
১. আল্লাহর রাহে যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে। ২/২১৬
২. ঈলার (স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার শপথ) বিধি-বিধান নাযিল হয়েছে। ২/২২৬ ৩. তালাকের বিস্তারিত বিধি-বিধান আলোকপাত করা হয়েছে। ২/২২৭-২৩২ ৪. দুগ্ধপোষ্য শিশুকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করানো বিধেয়। ২/২৩৩ ৫. গর্ভবতী না হলে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর ইদ্দত হলো চারমাস দশদিন (আর গর্ভবতী হলে ইদ্দত হলো সন্তান প্রসব পর্যন্ত)। ২/২৩৪
৬. সম্পদ ব্যয়ের সর্বাধিক উপযুক্ত খাত পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন ও মুসাফির ব্যক্তি। ২/২১৫
৭. ঋণের জামানত হিসেবে বন্ধক নেওয়া জায়েজ। ২/২৮৩
৮. আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন ও সুদ হারাম করে করেছেন। ২/২৭৫
৯. সুদ থেকে ফিরে না আসাকে আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য গণ্য করা হয়েছে। ২/২৭৫-২৭৯

সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা :
১. মুমিনদের সুসংবাদ এবং কাফিরদের বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিতে বলা হয়েছে। ২/২২৩, ৩/২১
২. ধৈর্য ধারণকারীদের সুসংবাদ দিয়ে বলা হয়েছে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। ২/১৫৫, ২/১৫৩
৩. শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২/১৬৮
৪. ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। এছাড়া অন্য কোনো ধৰ্ম গ্ৰহণযোগ্য হবে না। ৩/৮৫
৫. আল্লাহ আমাদের সব কিছুই দেখেন। ২/২৩৩, ২৩৭, ২৬৫ ৩/১৫, ২০

আল্লাহর প্রিয়-অপ্রিয় :
১. আল্লাহ তাওবাকারী ও ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন। ২/২২২
২. আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। ৩/৭৬
৩. তিনি কাফির ও জালিমদের ভালোবাসেন না। ৩/৩২, ৩/৫৭
৪. দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। ২/২০৫

বিশেষ ফজীলতপূর্ণ আয়াত :
আজকের তিলাওয়াতের অংশে রয়েছে আয়াতুল কুরসি। আল্লাহর মহান সত্তা এই আয়াতের আলোচ্যবিষয়। সকাল-সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসি পড়ার অনেক ফজিলত রয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর এটি পড়লে মৃত্যু ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার আর কোনো বাধা থাকে না।[১] রাতে ঘুমানোর পূর্বেও এটি পাঠ্য।[২] ২/২৫৫

বাকারার শেষ দুটি আয়াতও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো রাতে পড়বে, এগুলো তার জন্য যথেষ্ট হবে’ ।[৩] এই দুই আয়াত নবীজিকে মেরাজের রাতে বিশেষভাবে দান করা হয়েছে এবং কোনো নবীকে এই আয়াতগুলোর মতো মর্যাদাবান বাণী দেওয়া হয়নি।[৪] ২/২৮৫,২৮৬

আজকের শিক্ষা :
আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করলে রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ করতে হবে। ৩/৩১ আল্লাহর নবী ইবরাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ (সা.) সবার ধর্মই ছিল একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, শিরক থেকে মুক্ত। সুতরাং তাদের প্রকৃত অনুসারী হতে হলে একত্ববাদে বিশ্বাস করতে হবে।
ইহুদীদের মধ্যেও এমন লোক আছে যার কাছে সম্পদ আমানত রাখলে সে রক্ষা করে। সুতরাং শত্রুর কোনো ভালো গুণ থাকলে স্বীকার করতে হবে। ২/১৩৩, ৩/৬৭, ৭৫

নারী, সন্তান, সোনা-রূপা এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পদসমূহকে মানুষের জন্য সুশোভিত করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো ক্ষণস্থায়ী, পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী মাত্র। আল্লাহর কাছে রয়েছে সর্বোত্তম অবস্থান। ৩/১৪

আজকের দোয়া :
ربَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَ ثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَفِرِينَ

অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদের ওপর ধৈর্য ঢেলে দিন, আমাদের পা স্থির রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। ২/২৫০

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلُ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا اَنْتَ مَوْلنَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَفِرِينَ

অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না যদি আমরা ভুলে যাই বা ত্রুটি করি। হে আমাদের রব, আমাদের ওপর ভারি বোঝা চাপাবেন না, যেমন চাপিয়েছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। হে আমাদের রব, আমাদের ওপর এমন দায়িত্বভার অর্পণ করবেন না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের (ত্রুটিসমূহ) মার্জনা করুন, আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আপনি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। ২/২৮৬

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَقَابُ

অর্থ: হে আমাদের রব, আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা। ৩/৮

رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرُ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

অর্থ: হে আমাদের রব, আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আমাদের পাপরাশি ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। ৩/১৬

দ্রষ্টব্য :-
[১] আমালুল ইয়াওম ওয়াল লাইলা, ১০০
[২] সহিহ বুখারি, ২৩১১; সহিহ ইবনি খুযাইমা, ২৪২৪
[৩] সহিহ বুখারি, ৫০৪০; সহিহ মুসলিম, ৮০৭
[৪] সুনানুত তিরমিযি, ৩২৭৬

শেয়ার করুন