তৃতীয় তারাবীহতে পঠিতব্য কুরআনের অংশ হলো পুরো চতুর্থ পারা ও পঞ্চম পারার প্রথমার্ধ। অর্থাৎ, সূরা আলে ইমরানের শেষার্ধ ও সূরা নিসার প্রথমার্ধ।
সূরাতুন নিসা অর্থ নারীদের সূরা। এই সূরার শুরুতে নারী-পুরুষের সৃষ্টি রহস্য আলোকপাত করা হলেও পুরো সূরা জুড়ে নারী-অধিকার, নারী-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিধান, সম্পদ বণ্টন নীতিমালা এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আহকাম উঠে এসেছে।
ঘটনাবলি :
বদর ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ঐতিহাসিক বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাফিরদের তুলনায় মুসলমানরা সংখ্যা ও সরঞ্জামে পিছিয়ে ছিল। আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে সাহায্য করেছিলেন। ৩/১২৩-১২৫
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথমদিকে সাফল্য পেলেও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটি নির্দেশ থেকে সরে যাওয়ার কারণে বিপর্যয়ের শিকার হন। এতে স্বয়ং নবীজি-সহ অনেকে আহত হন এবং সত্তরজন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ মুসলমানদেরকে বেশ কিছু উপদেশ ও সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন,
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَ اَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِينَ
অর্থ : “তোমরা হীনম্মন্য হবে না, চিন্তিত হবে না, প্রকৃত মুমিন হলে তোমরাই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবে।” আর মহান আল্লাহ জয়-পরাজয়ের পালাবদল ঘটান। এ যুদ্ধে রাসূল (সা.) নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করে বলেন, রাসূলের (সা.) মৃত্যুসংবাদ গুজব হলেও অন্যান্য নবীদের মতো একদিন তিনিও দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। ৩/১৩৯-১৭২
পৃথিবীর প্রথম ঘর, যেটি মানুষের ইবাদতের জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেটি হলো মক্কার কাবাঘর। সেই ঘরকে মহান আল্লাহ বরকতময় এবং মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শনের মাধ্যম বলেছেন। ৩/৯৬, ৯৭
ঈমান-আকীদা :
শিরককারী তাওবা ছাড়া মারা গেলে সে অপরাধ আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্য অপরাধ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন (অবশ্য বান্দার হকও তিনি মাফ করবেন না)। ৪/৪৮
বিবাদে অকুণ্ঠচিত্তে রাসূলকে বিচারক না মানলে ঈমানদার হওয়া যাবে না। ৪/৬৫
মৃত্যুর মুহূর্তে যখন ফেরেশতা জান কবজ করার জন্য সামনে চলে আসেন, তখন তাওবা করলে সেই তাওবা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ৪/১৮
আদেশ :
■ আল্লাহর রাস্তায় প্রিয় বস্তু ব্যয় করা। ৩/৯২
■ একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মের (আদর্শ) অনুসরণ করা। ৩/৯৫
■ আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করা। ৩/১০২, ১২৩
■ সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরা। ৩/১০৩
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা। ৩/১৩২
■ আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া। ৩/১৩৩
■ ক্ষমা করা, অন্যের মাগফিরাত কামনা করা, কাজের আগে পরামর্শ করা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ৩/১৫৯
■ আল্লাহ ও তার রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা। ৩/১৭৯
■ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। ৩/১০৪
■ আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করা। ৩/১০৩
■ ধৈর্য ধারণ করা এবং যুদ্ধে অবিচল থাকা ও সীমান্ত পাহারা দেওয়া। ৩/২০০
■ এতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দেওয়া। ৪/২
■ আল্লাহর ইবাদত করা। ৪/৩৬
■ পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকীন, প্রতিবেশী ও পথচারীর সাথে সদ্ব্যবহার করা। ৪/৩৬
■ আমানতসমূহ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং ন্যায়বিচার করা। ৪/৫৮
■ আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও সিদ্ধান্তের মালিকদের আনুগত্য করা। ৪/৫৯
■ শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। ৪/৭৬
■ আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ৪/৮১
■ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। ৪/৮৪
নিষেধ :
■ পরিপূর্ণ মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ না করা। ৩/১০২
■ (মুসলমানরা) পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়া। ৩/১০৩
■ পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি না করা। ৩/১০৫
■ মুমিন কর্তৃক অন্যদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ৩/১১৮
■ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ না খাওয়া। ৩/১৩০
■ শয়তানের দোসরদের ভয় না করা। ৩/১৭৫
■ এতিমের সম্পদ নিজেদের সম্পদের সাথে মিশিয়ে ভক্ষণ না করা। ৪/২
■ একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস না করা এবং অন্যায়ভাবে হত্যা ও আত্মহত্যা না করা। ৪/২৯
■ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করা। ৪/৩৬
বিধি-বিধান :
১. সামর্থ্যবানদের ওপর বাইতুল্লাহর হজ করা ফরয। ৩/৯৭
২. ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করার শর্তে একজন পুরুষের জন্য সর্বোচ্চ চারটি পর্যন্ত বিয়ে করা জায়েজ। আর একাধিক স্ত্রীর মাঝে সমতা রক্ষা করতে না পারার আশঙ্কা থাকলে একটির ওপর সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশনা এসেছে। ৪/৩
৩. স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্ত্রীর মোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে কিছুটা শিথিল করলে সেটা বৈধ। ৪/৪
৪. মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ নিয়ে ওয়ারিসদের মাঝে যেন বিবাদ সৃষ্টি না হয় সেজন্য স্বয়ং আল্লাহ পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের নীতিমালা ও ওয়ারিসদের হিস্যা বর্ণনা করেছেন। এটা রক্ষা করা ফরয। ৪/৭-১৪
৫. ব্যভিচারের শাস্তি (বিচারিকভাবে) প্রয়োগ করতে চারজন চাক্ষুস সাক্ষী আবশ্যক। ৪/১৫
৬. ওজু করতে অক্ষম হলে তায়াম্মুম করা যাবে। ৪/৪৩
হালাল-হারাম :
নারী-পুরুষের মাহরামের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা নিসার ২৩ নং আয়াতে তেরো জন নারীর কথা বর্ণিত হয়েছে, যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম। এছাড়া মাদক হারামের বিধানও বর্ণিত হয়েছে। ৪/৪৩
শিষ্টাচার :
সালাম ইসলামী সামাজের অনুপম সৌন্দর্য। সালামের চেয়ে অর্থবহ অভিবাদন আরেকটি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউ সালাম (শান্তির দোয়া) দিলে তাকে আরো উত্তম ভাষায় জবাব দিতে হবে। সালাম দেওয়া সুন্নাহ হলেও এই নির্দেশের আলোকে সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। ৪/৮৬
দৃষ্টান্ত :
কাফিরদের সৎকর্মের বিনিময় দুনিয়াতেই দেওয়া হয়। কুফুরির কারণে আখিরাতে তারা কোনো সওয়াব পাবে না। বিষয়টিকে শস্যক্ষেতে হিমশীতল ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ভালো কাজকে শস্যক্ষেত্র এবং কুফুরির কারণে সেসবের বিনিময় নষ্ট হওয়াকে হিমশীতল ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুম করছেন বলার সুযোগ নেই। কারণ, কুফুরির মাধ্যমে তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মফল নষ্ট করেছে। ৩/১১৭
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য এবং বুদ্ধিমানের পরিচয় :
মহান আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত করেছেন মুত্তাকীদের জন্য। সমগ্র কুরআন জুড়ে মুত্তাকীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। সূরা নিসার দুটি আয়াতে মুত্তাকীদের চারটি বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে।
(এক) তারা সচ্ছল অসচ্ছল সকল অবস্থায় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। (দুই) তারা ক্রোধ সংবরণ করে। (তিন) তারা মানুষকে ক্ষমা করে। (চার) তারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ কিংবা নিজের প্রতি জুলুম (গুনাহ) করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। ৩/১৩৪, ১৩৫
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং রাত-দিনের পালাবদলে বুদ্ধিমানের জন্য রয়েছে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন; যারা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত্ব ও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে। ৩/১৯০, ১৯১
মৃত্যু, জান্নাত-জাহান্নাম ও প্রকৃত সফলকাম :
মৃত্যু অনিবার্য বাস্তবতা। মানুষ যেখানেই থাক না কেন, অবশ্যই মৃত্যু তাদের নাগাল পাবে, যদিও তারা সুরক্ষিত দূর্গের ভেতর থাকে। ৪/৭৮
তিনি আরো বলেন, সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন সবার প্রাপ্য কর্মফল বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে সে-ই হলো প্রকৃত ও চূড়ান্ত সফল। একই কথা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ হয়েছে। ৩/১৮৫
মুত্তাকীদের জন্য জান্নাত ও কাফিরদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করা হয়েছে। ৩/১৩১, ১৩৩
রাসূল (সা.)-এর মৌলিক কাজ :
নবীজি (সা.) ছিলেন আমাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ। তার মৌলিক কাজ তিনটি। তিনি মানুষের মাঝে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে শোনাতেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতেন এবং কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিতেন। ৩/১৬৪
দাম্পত্য কলহ নিরসনের পদ্ধতি :
দাম্পত্য কলহ নিরসনের ধারাবাহিক চারটি ধাপ রয়েছে। স্ত্রী অবাধ্য হলে প্রথমে তাকে উপদেশের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এতে কাজ না হলে অভিমান করে বিছানা পৃথক করবে। তাতেও কাজ না হলে শরীয়া সম্মতভাবে শাসন করতে হবে। এতেও সংশোধন না হলে এবং কলহ সৃষ্টি ও বিচ্ছেদের আশঙ্কা হলে উভয়পক্ষের একজন করে সালিস নিযুক্ত করে মীমাংসার চেষ্টা করতে হবে। ৪/৩৪, ৩৫
আজকের শিক্ষা :
নিজের কষ্টকে অন্যের সুখের সাথে তুলনা করলে মানুষ কখনো সুখী হয় না। উহুদ যুদ্ধ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ নিজেদের কষ্টের সময় অন্যের কষ্টের দিকে তাকানোর শিক্ষা দিয়েছেন। তাতে ধৈর্য ধারণ সহজ হয়। ৩/১৪০
একইভাবে অন্য আয়াতে রাসূল (সা.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, আপনাকে মক্কার মুশরিকরা অস্বীকার করে, (তাতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, কারণ) একইভাবে পূর্বের বিভিন্ন নবী-রাসূলকেও অস্বীকার করা হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায়, নিজের কষ্টকে অন্যের সুখের সাথে তুলনা না করে অন্যের দুঃখের সাথে তুলনা করা বুদ্ধিমানের কাজ। ৩/১৮৪
কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচিত গ্রন্থ হলে এতে বহু বৈপরীত্য ও অসংগতি পাওয়া যেত। ৪/৮২
আরো পড়ুন :
১ম তারাবীতে তেলাওয়াতকৃত সুরার শানে নুযুল, আদেশ-নিষেধ ও সুসংবাদ