চতুর্থ তারাবীহতে পঠিতব্য কুরআনের পঞ্চম পারার শেষার্ধ ও ষষ্ঠ পারা জুড়ে আছে সূরা নিসার অবশিষ্টাংশ ও মায়িদার দুই তৃতীয়াংশ।
সূরা মায়িদা সবচেয়ে বেশি বিধি-বিধান সংবলিত সূরা। এই সূরায় এমন আঠারটি বিধান উল্লেখ হয়েছে যা অন্য কোনো সূরায় উল্লেখ হয়নি। বিশেষ করে হালাল হারাম, জীব-জন্তু শিকার, আহলে কিতাবদের সাথে বিবাহ এবং তাদের খাবার গ্রহণ, অমুসলিমদের সাথে অন্তরঙ্গতা, চুরি, হত্যা, কিসাস, চুক্তি, শপথের বিধি-বিধান, মাদকের ভয়াবহতা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
ঘটনাবলি :
এক অভিযান শেষে সাহাবীগণ মদীনায় ফিরছিলেন। পথে এক অমুসলিমের সাথে তাদের দেখা। অমুসলিম সালাম দিয়ে কালিমা পাঠ করল। সাহাবীগণ ভাবলেন, লোকটি জীবন বাঁচানোর জন্য সালাম ও কালিমা পড়েছে। ভুল বুঝে তারা লোকটিকে হত্যা করে ফেললেন। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করে ঈমানদারদেরকে সতর্ক করলেন, তারা যেন যাচাই-বাছাই ছাড়া কারো ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে। এটি সূরা নিসার ঘটনা। ৪/৯৪
একই সূরায় বনী ইসরাইলের কয়েকটি অবাধ্যতার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তারা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখা ছাড়া ঈমান আনবে না মর্মে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে তাদের ওপর বজ্র আঘাত হেনেছিল। তারা আল্লাহর বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও বাছুর পূজায় লিপ্ত হয়। এরপরও আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন এবং তাদের অবাধ্যতার কারণে তূর পাহাড়কে অলৌকিকভাবে তাদের মাথার ওপর তুলে ধরে তাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেন। শনিবারে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকেও তারা অমান্য করে। ধারাবাহিক অবাধ্যতা, কুফুর ও নবীদের হত্যা করার কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেন। ফলে তাদের সত্য গ্রহণের প্রবণতা খুবই কম। ৪/১৫৩-১৫৫
ইহুদীরা ঈসা (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে মহান আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাকে আকাশে তুলে নেন। আর তারই একজন সহচরকে ঈসা মনে করে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। ৪/১৫৭-১৫৮
সূরা মায়িদার প্রথমদিকের একটি ঘটনা হলো, বনী ইসরাইলকে মূসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র ভূমিতে (ফিলিস্তিন) প্রবেশের নির্দেশ দিলে তারা সেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের অজুহাত তুলে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ প্রবেশ করলেই তাদের বিজয়ী হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে মহান আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ চল্লিশ বছর একই মরুভূমিতে ঘুরপাক খাওয়ান। ৫/২১-২৬
আদম (আ.)-এর ছেলে কাবিল হিংসার বশবর্তী হয়ে ভাই হাবিলকে হত্যা করে। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম রক্তপাত। ভাইয়ের লাশ নিয়ে বিপাকে পড়ে কাবিল। তখন একটি কাক কর্তৃক অপর মৃত কাককে মাটিতে পুঁতে ফেলার দৃশ্য দেখে ভাইয়ের লাশ দাফনের ধারণা পায় সে। এর প্রেক্ষিতে একজন মানুষ হত্যাকে মহান আল্লাহ গোটা মানবতাকে হত্যা করার মতো অপরাধ বলে বিধান দিয়েছেন। ৫/২৭-৩২
শিরকের শাস্তি :
শিরক মানে আল্লাহর অংশীদার সাব্যস্ত করা। শিরক সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ। শিরকের অপরাধ মাথায় নিয়ে কেউ মারা গেলে সে ক্ষমা পাবে না। ৪/১১৬
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। ৫/৭২
আদেশ :
■ সকল অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা। ৪/১০৩
■ সালাত আদায় করা। ৪/১০৩
■ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। ৪/১০৬
■ আল্লাহকে ভয় করা। ৪/১৩১
■ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা এবং সত্য সাক্ষ্য দেওয়া। ৪/১৩৫
■ আল্লাহ, তার রাসূল, ফেরেশতাগণ, আসমানি কিতাবসমূহ, পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা। ৪/১৩৬
■ অঙ্গীকার ও চুক্তি পূর্ণ করা। ৫/১
■ কল্যাণ ও তাকওয়ার কাজে পরস্পরের সহযোগিতা করা। ৫/২
■ পশু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নেওয়া। ৫/৪
■ আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করা। ৫/৭
■ সুবিচার ও ইনসাফ করা। ৫/৮
■ আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ৫/২৩
■ সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ করা। ৫/৩৫
■ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। ৫/৩৫
■ ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা। ৫/৪৮
■ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার ও শাসন করা। ৫/৪৯
■ আল্লাহর বাণী অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ৫/৬৭
নিষেধ:
■ কাফিরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ৪/৮৯
■ খেয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বন না করা। ৪/১০৫
■ ইনসাফ করার সময় ইচ্ছা-অভিরুচির অনুসরণ না করা। ৪/১৩৫
■ ইহরাম অবস্থায় পশু শিকার না করা। ৫/২
■ পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরের সহযোগিতা না করা। ৫/২
■ শত্রুর সাথেও বে-ইনসাফি না করা। ৫/৮
■ আল্লাহর ওপর মানুষকে প্রাধান্য না দেওয়া এবং তুচ্ছমূল্যে আল্লাহর আয়াতসমূহ বিক্রি না করা। ৫/৪৪
■ ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ৫/৫১
■ ধর্মকে যারা ক্রীড়া-কৌতুকের বস্তু বানায় এবং যারা কাফির, তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ৫/৫৭
হালাল-হারাম :
সূরা মায়িদার শুরুতে নিষিদ্ধ ঘোষিত বস্তু ছাড়া যাবতীয় চতুষ্পদ গবাদি পশু ও তদসদৃশ জন্তু হালাল করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বল্পসংখ্যক হারাম বস্তু ছাড়া সব কিছুই মূলত আমাদের জন্য হালাল। এজন্য কুরআনে হালালের তালিকা দেওয়া হয়নি, হারামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। হারামের তালিকা : মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবাইকৃত পশু, শ্বাসরোধে মৃত পশু, প্রহারে মৃত পশু, উপর হতে পতনে মৃত পশু, অন্য কোনো পশুর শিংয়ের আঘাতে মৃত পশু এবং হিংস্র জন্তুর খাওয়া পশু ইত্যাদি। ৫/১, ৫/৩
বিধি-বিধান :
১. কারো ভুলের কারণে কোনো ঈমানদার মারা গেলে তার ওপর কাফফারা এবং রক্তমূল্যের বিধান বর্ণিত হয়েছে। ৪/৯২
২. কসরের সালাত এবং যুদ্ধাবস্থায় সালাতুল খাউফের বিধি-বিধান আলোচিত হয়েছে। ৪/১০১-১০৩
৩. যার সন্তান-সন্ততি নেই এবং পিতা-মাতাও বেঁচে নেই, তাকে কালালাহ বলা হয়। কালালাহর মৃত্যু পরবর্তী পরিত্যক্ত সম্পদের বিধান আলোচনা করা হয়েছে আজকের তারাবীহর তিলাওয়াতকৃত অংশে। ৪/১৭৬
৪. ওজু-গোসল এবং ওজু-গোসলে অপারগ হলে তায়াম্মুম করার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। ৫/৬
৫. চোরের হাত কেটে দেওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। ৫/৩৮
৬. ইসলামের সুবিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো কিসাসের বিধান। কিসাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আজকের তিলাওয়াতে। ৫/৪৫
৭. নারী এবং এতিম মেয়েদের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ ও দাম্পত্য কলহ নিরসনে মীমাংসাকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্যে কল্যাণের কথা বর্ণিত হয়েছে। ৪/১২৭-১৩০
কয়েকটি সতর্কীকরণ :
১. মানুষকে শয়তান কীভাবে নিজের দাসে পরিণত করে তার বিবরণ উল্লেখের পর যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধু ও অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে তার পরিণতি বর্ণিত হয়েছে। ৪/১১৯
২. সূরা নিসা ও সূরা মায়িদায় বেশ কয়েক স্থানে খ্রিস্টানদের মৌলিক বিশ্বাস ত্রিত্ববাদের অসারতা, তার খণ্ডন এবং ঈসা (আ.) যে আল্লাহর পুত্র নন বরং তার রাসূল, সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। ৪/১৭১ ৫/১৭, ৭৩-৭৫
৩. ঈমানদারদের জন্য মুনাফিক (মুসলিম সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা মুসলিমরূপী অমুসলিমদের দোসর) চেনা বেশ কঠিন, অথচ তাদের ক্ষতি সীমাহীন। এজন্য কুরআনে বারবার তাদের আলামত সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। সূরা নিসায় অনেকগুলো আয়াতে তাদের চরিত্র তুলে ধরে জাহান্নামের অতল গহ্বরে তাদের ঠিকানা হওয়ার পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে। ৪/১৩৭-১৪৫
৪. মুসলিমদের প্রতি সবচেয়ে বেশি শত্রুতা পোষণ করে ইহুদী এবং মুশরিকরা। খ্রিস্টানরা তাদের তুলনায় কিছুটা সহনশীল হয়। এজন্য পুরো কুরআন জুড়ে ইহুদীদের কূটকর্মের ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। শিরক ও মুশরিকদের অসারতার আলোচনাও বারবার উঠে এসেছে। ৫/৮২
আল্লাহর প্রিয়-অপ্রিয় :
আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন। ৫/১৩, ৯৩
আল্লাহ ন্যায়বিচারকদেরকে ভালোবাসেন। ৫/৪২
আল্লাহ খেয়ানতকারী (বিশ্বাসঘাতক) পাপিষ্ঠকে পছন্দ করেন না। ৪/১০৭
আল্লাহ (জুলুম ছাড়া) কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। ৪/১৪৮ আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না। ৫/৬৪