১১তম তারাবিতে পঠিতব্য কুরআনের ১৪ নম্বর পারায় রয়েছে সূরা হিজর ও সার নাহল। প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বজাতিকে কল্যাণের পথে আহ্বান করতে। গিয়ে যখন বিরামহীন বাধা, বিদ্রূপ আর জুলুম-নির্যাতনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন, তখন সান্ত্বনা হিসেবে মহান আল্লাহ পূর্বের নবী-রাসূলদের বেদনাহত জীবনের ইতিহাস তুলে ধরে সূরা হিজর নাযিল করেন। হিজর মক্কা ও তাবুকের মাঝে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এ সূরায় হিজরবাসীর অবাধ্যতার ইতিহাস আলোচিত হয়েছে বিধায় এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে হিজর নামে।
নাহল অর্থ মৌমাছি। সূরা নাহলে মৌমাছি, মধু, মধুর উপকারিতা প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে এবং প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে যে, মধুর মধ্যে শেফা ও আরোগ্য লাভের উপাদান রয়েছে। এ কারণে এই সূরার নাম নাহল। ১৬/৬৮-৬৯
ঘটনাবলি :
মানুষ ও জিন জাতির সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ইতিহাস আলোচিত হয়েছে আজকের পঠিতব অংশে। মহান আল্লাহ মানুষকে কৃষ্ণবর্ণের কাদার ঠনঠনে মাটি থেকে এবং জিনদেরকে উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে, সবাইকে নির্দেশ করলেন, তারা যেন আদমকে সম্মানসূচক সিজদা করে। কিন্তু সবাই সিজদা করলেও ইবলীস অহংকারবশত সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহ তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করেন এবং প্রতিশোধপরায়ণ ইবলীস আদম সন্তানকে বিপথগামী করার সংকল্প করে। ১৫/২৬-৪৪
আজকের পঠিতব্য অংশে ইবরাহীম (আ.)-এর একটি ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে। ইবরাহীম (আ.)-এর বৃদ্ধ বয়সের ঘটনা এটা। একদা ফেরেশতাদের একটি দল (মানুষের আকৃতিতে) ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে একটি জ্ঞানী সন্তানের সুসংবাদ নিয়ে আগমন করেন। ইবরাহীম (আ.) মানুষ ভেবে তাদেরকে আপ্যায়ন করতে গেলে তারা জানান তারা ফেরেশতা (ফেরেশতাদের খাদ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয় না)। বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের সুসংবাদ শুনে বিস্মিত হন ইবরাহীম (আ.)। নবীর বিস্ময় দেখে ফেরেশতাগণ আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ না হওয়ার কথা বলেন। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ফেরেশতারা জানান, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নবী লুত (আ.)-এর জাতি তাদের নবীর অবাধ্যতা এবং সমকামিতার মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় তারা আল্লাহর আযাব নিয়ে আগমন করেছেন।
এরপর ফেরেশতারা লুত (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুদর্শন (মানুষরূপী) ফেরেশতাদের দেখে পাপিষ্ঠ সম্প্রদায় তাদের সাথে অপকর্ম করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ফেরেশতাগণ লুতকে অনুসারীদের নিয়ে এলাকা ত্যাগ করতে বলেন। এরপর একদিন ভোরে তাদের ওপর আল্লাহর আযাব তথা মহানিনাদ এবং প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। পুরো এলাকা সম্পূর্ণ উল্টে দেওয়া হয়। আল্লাহ এটাকে ঈমানদারদের জন্য নির্দশনবহুল ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ১৫/৫১-৭৭
আল্লাহর হুকুম অমান্য করার কারণে আইকাবাসী অর্থাৎ শুয়াইব (আ.)-এর সম্প্রদায়কেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনারও ইঙ্গিত রয়েছে এই সূরায়। ১৫/৭৮-৭৯
ছালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের নাম ছিল ছামুদ। তারা নিরাপদে বসবাসের জন্য পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করত। কিন্তু আল্লাহর হুকুম অমান্য করা এবং নবীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার কারণে বিকট আওয়াজের গজব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল। ১৫/৮০-৮৪
মহান আল্লাহ সকল নবী-রাসূলকে মৌলিকভাবে দুটি বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। এক. আল্লাহর ইবাদত করা। দুই. তাগুত বর্জন করা। ১৬/৩৬
আদেশ :
■ আল্লাহকে ভয় করা। ১৫/৬৯
■ মুমিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। ১৫/৮৮
■ আল্লাহর ইবাদত করা ও তাগুত বর্জন করা। ১৬/৩৬
■ পৃথিবীতে ভ্রমণ করে মিথ্যারোপকারীদের শেষ পরিণতি দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা। ১৬/৩৬
■ অজানা বিষয় জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞাসা করা। ১৬/৪৩
■ কুরআন পাঠের শুরুতে বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা অর্থাৎ ‘আউযুবিল্লাহ’ পাঠ করা। ১৬/৯৮
■ ইনসাফ করা, অনুগ্রহ করা এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করা। ১৬/৯০
■ আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করা যখন পরস্পর অঙ্গীকার করা হয়। ১৬/৯১
■ রিযিক হিসেবে আল্লাহ যে হালাল ও পবিত্র বস্তু দান করেছেন, তা ভক্ষণ করা। ১৬/১১৪
■ আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। ১৬/১১৪
■ মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণ করা। ১৬/১২৩
■ ধৈর্য ধারণ করা। ১৬/১২৭
নিষেধ :
■ যারা (আল্লাহর রহমত থেকে) নিরাশ হয় তাদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। ১৫/৫৫
■ (কাফিরদের) ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দেওয়া হয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত না করা। ১৫/৮৮
■ (কাফিরদের ঈমান না আনার কারণে) দুঃখ না করা। ১৫/৮৮
■ দুই উপাস্য গ্রহণ না করা। ১৬/৫১
■ আল্লাহর কোনো সদৃশ সাব্যস্ত না করা। ১৬/৭৪
■ অশ্লীল, অসঙ্গত কাজ এবং জুলুম না করা। ১৬/৯০
■ দৃঢ় করার পর শপথ ভঙ্গ না করা। ১৬/৯১
■ সুতো পাকিয়ে মজবুত করে পাক খুলে দেওয়া নারীর মতো না হওয়া। অর্থাৎ ভালো কাজ সম্পন্ন করার পর তা নষ্ট না করা।
■ অঙ্গীকারকে পরস্পরের প্রতারণার অস্ত্র না বানানো। ১৬/৯৪
■ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি না করা। ১৬/৯৫
■ কাফিরদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট না করা। ১৬/১২৭
দৃষ্টান্ত :
আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপনের অসারতা প্রমাণ করতে দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। প্রথম দৃষ্টান্ত দুজন মানুষের। তাদের একজন মালিক অপরজন ক্রীতদাস। প্রথমজন আল্লাহর দেওয়া রিযিক থেকে অকাতরে দান করতে পারে। দ্বিতীয়জন ক্রীতদাস হওয়ায় কিছুই করতে সক্ষম নয়। তারা দুজনই মানুষ অথচ সমান নয়। তাহলে কোনো সৃষ্টি কি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারে? কীভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে কোনো সৃষ্টিকে উপাস্য সাব্যস্ত করে মুশরিকরা? ১৬/৭৫
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত এমন দুজন মানুষের, যাদের একজন নিজে সরল-সুন্দর পথে পরিচালিত হয় আবার অন্যদেরকেও ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দান করতে সক্ষম। আর অপরজন বোবা ও অথর্ব। অন্যের কল্যাণ তো দূরের কথা, সে নিজেই নিজের বোঝা। তারা দুজনই মানুষ এবং একই জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সমান নয়। তাহলে মহান আল্লাহ আর মুশরিকদের পূজনীয় মূর্তি কীভাবে সমান হতে পারে? ১৬/৭৬
হালাল-হারাম :
আল্লাহ মৃত প্রাণী, রস্ত, শূকর এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবাই করা প্রাণী ভক্ষণ করাকে হারাম করেছেন। ১৬/১১৫
ধারণাপ্রসূত কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম মন্তব্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, এর অর্থ হবে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যারোপ করা। ১৬/১১৬
আল্লাহর নিয়ামতের সীমা :
আল্লাহর সীমাহীন নিয়ামতরাজির কয়েকটির ঈমানজাগানিয়া বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিয়মতসমূহ যদি তোমরা গণনা করো তবে গুনে শেষ করতে পারবে না। ১৬/৫-১৮
ইসলাম নারীকে মুক্ত করে সম্মানিত করেছে :
কন্যা সন্তানের সংবাদে মক্কার মুশরিকদের চেহারা কালো হয়ে যেত। তারা লোকলজ্জায় মুখ লুকাতো। ১৬/৫৮, ৫৯
অথচ সূরা নিসা নামের বিশাল এক সূরায় নারীর অধিকার ও মর্যাদার কথা বিশদভাবে বর্ণনা করেছে কুরআন। নবীজির বহু হাদীস মায়ের জাতিকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে।
ইসলাম প্রচারের মূলনীতি :
তুমি আপন প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমাহ ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে। আর (কখনো বিতর্কের সম্মুখীন হলে) উৎকৃষ্টতম পন্থায় বিতর্ক করবে। ১৬/১২৫
ব্যাপক নির্দেশসূচক একটি আয়াত :
সূরা নাহলের ছোট একটি আয়াতে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। (এক) ন্যায়বিচার। (দুই) দয়া। (তিন) আত্মীয়দের হক আদায়। (চার) অশ্লীলতা পরিহার। (পাঁচ) মন্দকাজ পরিহার। (ছয়) জুলুম থেকে বিরত থাকা। ১৬/৯০
কুরআন হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর :
মহান আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন এবং নিজেই কুরআন সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে কুরআন সব ধরনের বিকৃতি থেকে মুক্ত থাকবে। ১৫/৯
কিয়ামতের দিন কাফিরদের আকাক্সক্ষা :
কিয়ামতের দিন কাফিররা জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতা দেখে আকাক্সক্ষা করে বলবে, ‘দুনিয়াতে তারা যদি মুসলমান হতো’। ১৫/২
সুসংবাদ ও সতর্কতা :
আল্লাহ বলেছেন, ‘আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও, আমি অতি ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু আর আমার শাস্তিই হলো যন্ত্রদায়ক শাস্তি’। ১৫/৪৯-৫০
ঈমানদার আল্লাহভীরুদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা সালাম দেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন। ১৬/৩২
পুরুষ হোক কিংবা নারী, ঈমান আনার পর সৎকর্মশীল হলে মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়াতে সুখী ও পবিত্র জীবন দান করবেন এবং আখিরাতে দান করবেন তাদের কর্মের সর্বোত্তম বিনিময়। ১৬/৯৭
কিয়ামতের দিন কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা ও দুর্গতি। ১৬/২৭-২৯
মানুষের কথার আঘাতে কষ্ট পেলে তিন করণীয় :
১. আল্লাহর প্রশংসামাখা তাসবীহ পাঠ করা।
২. সিজদা করা।
৩. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ প্রতিপালকের ইবাদত অব্যাহত রাখা। ১৫/৯৭-৯৯
ফজীলত ও মর্যাদা :
একই সূরার শেষের দিকে ইবরাহীম (আ.)-এর আদর্শের সৌন্দর্য এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার মর্যাদার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ১৬/১২০-১২৩
আল্লাহ যাদেরকে অপছন্দ করেন :
আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না। ১৬/২৩
অধিক আলোচিত বিষয় :
আজকের তিলাওয়াতকৃত উভয় সূরায় আল্লাহর বিভিন্ন নিয়ামত ও অনুগ্রহের কথা বারবার আলোচিত হয়েছে।