১২ তম তারাবিহর পঠিতব্য অংশ হলো কুরআনের ১৫ নম্বর পারা। এতে রয়েছে সম্পূর্ণ সূরা বনী ইসরাইল ও সূরা কাহাফের দুই তৃতীয়াংশ।
ঘটনাবলি :
ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ আর মি’রাজ অর্থ ঊর্ধ্বে গমন বা ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ইসরা ও মি’রাজ ছিল নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মু’জিযা। মহান আল্লাহ এক রাতে তাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা এবং মসজিদুল আকসা থেকে উর্ধাকাশে ভ্রমণ করিয়েছেন। সেখানে তিনি জান্নাত-জাহান্নাম এবং অদৃশ্যের জগতের বহু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেছেন। সূরা বনী ইসরাইলের শুরুতে রাসূলের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ১৭/১
বনী ইসরাইলের অবাধ্যতা, নাফরমানি এবং তাদের করুণ পরিণতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে এই সূরার প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতে। ধারাবাহিক অবাধ্যতা, তাওরাত অস্বীকার, নবীহত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল ইহুদীরা। ফলে তাদের ওপর দুটি শাস্তি নেমে আসে। প্রথমত, বাবেলের রাজা বুখত নসর তাদের ওপর গণহত্যা চালায়। যারা বেঁচে যায় তাদেরকে দাসত্ব বরণ করতে হয়। এটা ছিল মূসা (আ.)-এর মৃত্যুর পর তার শরীয়ত অমান্য করার শাস্তি। দ্বিতীয়ত, ঈসা (আ.)-এর অবাধ্যতার পর রোম সম্রাট তীতৃসের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তারা। এরপর মুহাম্মাদ (সা.)-এর অবাধ্যাচরণ করলে একই পরিণাম ভোগ করতে হবে, সেই ইঙ্গিত রয়েছে এই সূরায়। (অনেক মুফাসসিরের ধারণা, হিটলারের গণহত্যা তারই বাস্তবায়ন। আল্লাহই ভালো জানেন)। ১৭/২-৮
ইসলামপূর্ব যুগে আসহাবে কাহাফের (ঘুমন্ত গুহাবাসী যুবকদের) ঘটনা নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিল। রাসূল (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পূর্বের এই ঘটনা সম্পর্কে সূরা কাহাফে সঠিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। তারা ছিলেন ঈসা (আ.)-এর অনুসারী, একত্ববাদে বিশ্বাসী মুমিন। রাষ্ট্রীয় জুলুম এবং শিরক থেকে বাঁচতে লোকালয় ছেড়ে তারা গুহায় আশ্রয় নেন। তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর। মহান আল্লাহ তাদেরকে অলৌকিকভাবে তিনশ নয় বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। এরপর তাদেরকে জাগ্রত করেন। তারপর তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এই ঘটনা সত্যান্বেষণকারীদের জন্য প্রেরণা।
আসহাবে কাহাফের সেই গুহা তুরস্কের ইজমিরে অবস্থিত। কোনো কোনো গবেষকের মতে, জর্ডানের পেট্রায় গুহাটি আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৮/৯-২৬
সূরা কাহাফের গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো মুসা ও খিজির (আ.)-এর ঘটনা। মূসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে জ্ঞান অর্জনের জন্য খিজির (আ.)-এর সঙ্গী হন। পথে একাধিক অস্বাভাবিক ও শিক্ষণীয় ঘটনার মুখোমুখী হন তিনি। এই সফর থেকে মূসা (আ.) অনেক অজানা বিষয় জানতে পারেন। জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্যও এই ঘটনায় শিক্ষার অনেক উপকরণ রয়েছে। ১৮/৬০-৮২
ঈমান-আকীদা :
রবের পক্ষ হতে সত্য প্রকাশিত হবার পর যার ইচ্ছা ঈমান আনুক, যার ইচ্ছা কুফুরী করুক, পৃথিবীতে কাউকে বাধ্য করা হবে না। তবে আখিরাতে অবিশ্বাসীদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সেখানে তারা পানি চাইলে গলিত শিশার ন্যায় পানীয় দেওয়া হবে, যা তাদের চেহারাকে ঝলসে দেবে এবং সেটা হবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট পানীয়। ১৮/২৯
আরব মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করত। এটাকে আল্লাহ বিয়ে। গুরুতর ও জঘন্য উক্তি বলে অভিহিত করেছেন (কারণ তিনি এসবের উর্ধ্বে)। ১৭/৪০
মানবদেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ ও অস্থিতে পরিণত হওয়ার পর তারা নতুন সৃষ্টিরূপে কীভাবে পুনরুত্থিত হবে-অবিশ্বাসীদের এ সংশয় দূর করতে গিয়ে বলা হয়েছে, নমুনাবিহীন প্রথমবার যিনি মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন, পুনরায় সৃষ্টি করা তার জন্য কি কঠিন হওয়ার কথা? ১৭/৪৯-৫১
আদেশ :
■ মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার ও বিনীত আচরণ করা। ১৭/২৩, ২৪
■ আত্মীয়-সুজন, মিসকীন ও মুসাফিরদের হক আদায় করা। ১৭/২৬
■ নম্রভাবে কথা বলা। ১৭/২৮
■ অঙ্গীকার পূর্ণ করা। ১৭/৩৪
∎ সঠিকভাবে পরিমাপ করা। ১৭/৩৫
■ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। ১৭/৭৮
■ তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা। ১৭/৭৯
নিষেধ :
■ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কর্মবিধায়ক সাব্যস্ত না করা। ১৭/২
■ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে উপাস্য না বানানো। ১৭/২২
■ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা। ১৭/২৩
■ পিতা-মাতাকে ধমক না দেওয়া এবং তাদেরকে ‘উফ’ শব্দও না বলা।১৭/২০
■ অপব্যয় না করা। ১৭/২৬
■ কৃপণতা কিংবা অপব্যয় না করা। ১৭/২৯
■ দরিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা না করা। ১৭/৩১
■ যিনা-ব্যভিচারের কাছেও না যাওয়া। ১৭/৩২
■ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা। ১৭/৩৩
■ এতিমদের সম্পদে অবৈধ হস্তক্ষেপ না করা। ১৭/৩৪
■ যে বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে কথা না বলা। ১৭/৩৬
■ পৃথিবীতে দম্ভভরে না চলা। ১৭/৩৭
■ সালাতে বেশি উচ্চস্বরে কিংবা নিম্নস্বরে কিরাত পাঠ না করা। ১৭/১১০
গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান :
আল্লাহ নিরঙ্কুশভাবে তার ইবাদতের নির্দেশের পরপরই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকে ফরয করেছেন। পিতামাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ধমক দিতে, এমনকি ‘উফ’ পর্যন্ত বলতে নিষেধ করেছেন আল্লাহ। ১৭/২৩
ভবিষ্যৎকালীন কথায় ইনশাআল্লাহ যুক্ত করে বলতে হবে। ১৮/২৩-২৪
দৃষ্টান্ত :
বনী ইসরাইলের দুই ভাইয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন আল্লাহ। উভয়ই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রচুর ধন-সম্পদ, বাগ-বাগিচার মালিক হয়। তাদের একজন ছিল ঈমানদার ও কৃতগ্র অপরজন ছিল কাফির ও অহংকারী। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় ও দান-সাদাকা ছিল মুমিন ভাইয়ের অভ্যাস। এতে সম্পদ কিছুটা কমলেও তার ওপর ছিল আল্লাহর অসীম রহমত। আর কাফির ভাইটি পরকালকে অস্বীকার করত। ভোগবিলাসিতা ছিল তার জীবনের একমাত্র আরাধ্য। সহসা আল্লাহর আযাব তার সকল সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। তখন আফসোস ব্যতীত আর কিছুই করার থাকে না তার। ১৮/৩২-৪৪
অপর জায়গায় মহান আল্লাহ পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে বৃষ্টির পানির সাথে তুলনা করেছেন। বৃষ্টির পানি উদ্ভিদরাজির ভেতর প্রাণের উন্মেষ ঘটায়। কিন্তু একটা সময় পানি ফুরিয়ে (পানির কার্যকরিতা শেষ হয়ে) গেলে সেই প্রাণও শুকিয়ে যায়; শুল্ক খড়কুটোয় পরিণত হয়। মানুষের পার্থিব জীবনও ঠিক সেরকম। পার্থিব জীবনের প্রাচুর্য মানুষকে সুশোভিত ও সমৃদ্ধ করে। তাতে অনেকেই আখিরাত ভুলে দুনিয়াকে অফুরন্ত মনে করে। অথচ হায়াতের দিন ফুরালে একটা সময় সেও নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৮/৪৫
ফজিলত :
■ কুরআনে দুটি মসজিদের নাম এসেছে। এক. মসজিদুল হারাম, দুই. মসজিদুল আকসা। এ থেকে এই দুটি মসজিদের বিশেষ মর্যাদা প্রতীয়মান হয়। মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসা যথাক্রমে পৃথিবীর প্রথম ও দ্বিতীয় মসজিদ। মসজিদুল আকসার আশপাশের এলাকাকে কুরআনে বরকতময় বলা হয়েছে। আর বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা মসজিদুল হারামের আশপাশের এলাকাও বরকতময় হওয়া প্রমাণিত। [১] ১৭/১
■ জুমার দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করলে সেটি তিলাওয়াতকারীর জন্য নূর হয়ে আবির্ভূত হবে।
■ সূরা কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ রাখলে সে ব্যক্তি দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্ত থাকবে। (৩)
■ মানবজাতিকে মহান আল্লাহ শ্রেষ্ঠ জীব করে সৃষ্টি করেছেন। ১৭/৭০
সুসংবাদ ও সতর্কতা :
■ কুরআন মানবজাতিকে সরল পথ দেখায় এবং ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদেরকে মহা পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করে। আর যারা পরকাল বিশ্বাস করে না তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ১৭/৯-১০
■ অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। ১৭/২৭
■ ‘বলো, সত্য এসে গেছে আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই।’
[১] সহীহ বুখারী, ১৮৮৫, সহীহ মুসলিম, ১৩৬৯
[২] সুনানুদ দারিমী, ৩৪০৭
[৩] সহীহ মুসলিম, ১৭৬৮
এক আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ :
মহান আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে এবং কায়েম করবে ফাজরের কুরআন পাঠও’। এই আয়াতে সূর্য হেলে যাওয়া থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত সালাত আদায়ের নির্দেশের মাধ্যমে চার ওয়াস্থ (যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা) সালাতের আদেশ করা হয়েছে। আর ফজরের কুরআন পাঠের নির্দেশের মাধ্যমে ফজরের সালাতের কথা বলা হয়েছে। ১৭/৭৮
কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। যে ব্যক্তি সরল পথে চলে, সে সরল পথে চলে নিজের মঙ্গলের জন্যই। আর যে ব্যক্তি ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে, তার ভ্রান্তির পরিণাম তার নিজের ওপরই বর্তাবে। কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না। ১৭/১৫
তাহাজ্জুদের সালাত :
তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের নির্দেশ ও তার মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। ১৭/৭৯
বৃহ কী :
বৃহ হলো মহান আল্লাহর আদেশ। ১৭/৮৫
সিজদার আয়াত :
সূরা বনী ইসরাইলে একটি সিজদার আয়াত রয়েছে। আয়াতটি হলো-
وَ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا
অর্থ :- তারা ক্রন্দন করতে করতে থুতনির ওপর লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনীতভাব আরো বৃদ্ধি পায়। ১৭/১০৯
কুরআনের অলৌকিকত্ব :
পৃথিবীর সকল মানুষ ও জিন পারস্পরিক সাহায্য নিয়েও কুরআনের মতো গ্রন্থ রচনা করতে পারবে না। ১৭/৮৮
আজকের দোয়া :
رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيْنِي صَغِيرًا
অর্থ : হে আমার রব, আমার পিতা-মাতা উভয়ের প্রতি আপনি এমনভাবে রহম করুন, যেমন তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন। ১৭/২৪