মাহমুদ আহমদ
সম্প্রতি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি-থানচি এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আরও পাঁচ প্রশিক্ষণরত সদস্যকে আটক করেছে র্যাব। জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে গঠিত জঙ্গিদের নতুন প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হয়েছে সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য। দেশে বিভিন্ন সময় জঙ্গি তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কখনও ইসলাম সমর্থন করে না। আজ যারা ধর্মের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চিন্তায় একত্র হচ্ছে তারা মূলত প্রকৃত ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। কেননা প্রেমপ্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্য কথায়, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এ বিশ্ব এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা।
অথচ এই শান্তিপ্রিয় ধর্ম ইসলামের গুটিকতক বিপথগামীদের ভয়ে অনেকেই আজ শঙ্কিত। দুর্ভাগ্যক্রমে তথাকথিত কিছু ইসলামি দল এবং তাদের সহযোগী অন্যরা শান্তির ধর্ম ইসলামকে কালিমাযুক্ত করেছে। ইসলামের নাম শুনলেই যেন তরবারির ঝন-ঝনানী, বোমাবাজি আর আত্মঘাতী হামলার এক ছাপ মানুষের হৃদয়পটে ভেসে ওঠে। অথচ ইসলামের এই আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।
কোনোক্রমেই এ ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না, ইসলাম প্রচারে তরবারী প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে নিশ্চিত ভাবেই তরবারী ব্যবহৃত হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল, এটাই সত্য ঈমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারি কখনও ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ঈমানী বিষয়গুলো তো মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম তের বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি, মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদেরকে ফিরতি যুদ্ধ করতে হয়েছে। চাপ প্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কী এমন কোরবানি করতে পারে?
অনেকে এই প্রশ্নও করে থাকে যে, ইসলাম যদি শান্তির ধর্মই হয়ে থাকে, তবে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছে কেন? তাহলে শুনুন, মুসলমানদের যুদ্ধ করার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী আক্রমণ, আর মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এই রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবদের রীতি ছিল এটা আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত। তৃতীয়ত, যুদ্ধ করা হলে তা করা হবে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে যে, তারা এক আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফিররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিত না।
তবে এটা ঠিক যে, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যুদ্ধের প্রয়োজন কখনও ছিল না। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করছে যে, মুসলমানরা কোন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কোন একজনকেও মুসলমান হতে কখনও বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে। যুদ্ধপরিস্থিতিতে মহানবি (সা.) সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন যে, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না, আর উপাসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।
মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সেজন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ অর্থাৎ ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি কর’ নেয়া হতো। আর কারও যদি তা দেয়ার সামর্থ্য না থাকতো, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেয়া হতো।
ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক।
সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। ইসলাম একটি যুদ্ধংদেহী ধর্ম এটি অপবাদ ও সর্বৈব মিথ্যা। বাস্তবতা হলো, কী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল, যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন? মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯০)।
বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পারো। অধিকন্তু, এখানে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না।
আগ্রাসন বলতে কী বুঝায়? সে যুগে ইসলাম বিরোধীরা পরাজিত সৈন্যদের দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে বিকৃত করতো, এটা সমর নীতির পরিপন্থী, জিঘাংসামূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। ধমীর্য় নেতাদের পাদ্রীপুরোহিত, রাব্বী, প্রমুখদেরকে তাদের উপসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবল সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোন বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবুও কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।
আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামী শিক্ষার ওপর কোন দলই আমল করছে না। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে, অপরদিকে, আগ্রাসী বাহিনী, শহর, নগর-বন্দরে বোমা বর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগরঅবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না।
প্রতিটি বৃহৎশক্তিই এখন পারমাণবিক বিপুল অস্ত্র সম্ভারের অধিকারী, এমনকী দরিদ্র দেশগুলো পর্যন্ত অস্ত্রসম্ভার মজুত করণের এই দৌড়ে শামিল হচ্ছে। মানবজাতি একেবারে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে, যেখানে কী না পবিত্র কোরআন আমাদেরকে নিরপরাধ, নিরীহদের কোন ক্ষতি না করার শিক্ষা দেয়, সেখানে পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও শারীরিক প্রতিবন্ধীতা ঘটায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। সুতরাং এটা তো হত্যা করার চেয়েও জঘন্যতর অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল বিশ্ব এমন এক মারাত্মক মারণাস্ত্র বানানো থেকে হয়তো বিরতই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেসব অস্ত্রের প্রাণ সংহারী ক্ষমতা বাড়াতে তারা আরও এগিয়ে গেছে। আর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সামগ্রিক ধ্বংসলীলা সাধনকারী মারণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটেই চলছে।
মূলত একজন মুসলমানের বিনা কারণে যুদ্ধে লিপ্ত হবার অনুমতি নেই, যদি না তা এমন লোকদের বিরুদ্ধে হয়, যারা আল্লাহর দ্বীন পালনে ও প্রচারে বাধা দেয় অথবা বিশ্বে শান্তি বিনাশের কারণ হয়। শান্তি বজায় রাখতে এটা অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষা নয় কী? আল্লাহতাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর তারা সন্ধির জন্য হাত বাড়ালে তুমিও এর জন্য হাত বাড়িয়ে দিও এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ’ (৮ : ৬১)।
সুতরাং এটা হলো ইসলামি শিক্ষা। চরমপন্থী মতাদর্শের কোন স্থান এখানে নেই। এতসব নমুনা ও আদর্শ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আপত্তি হলো-পবিত্র কোরআন ও মহানবি (সা.) চরমপন্থা অবলম্বন করা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর শিক্ষাও দেয়, নাউযুবিল্লাহ। পড়ালেখা জানা সুশীল ও শিক্ষিত সুধীজন হয়েও, এমন চিন্তা মনে কীভাবে আসে? আসলে ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীনতা ও অজ্ঞতাই এমন সমালোচনার কারণ হতে পারে। ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে বাস্তবে হিংসাবিদ্বেষ পুষে রাখার জন্য তারা এ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানতে চান না, আর এরাই সেই সব লোক, যারা শান্তি বিঘ্নিত করার কারণ হয়ে থাকেন।
আসলে ‘ইসলাম’ এর প্রকৃত চেহারা বিকৃত করছে কতিপয় জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দল, তাদের সেসব কার্যকলাপ ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, যদিও তারা ধর্মযুদ্ধের নামে বিশৃঙ্খলা করতে পবিত্র কোরআনের সমর্থনের ধুয়া তুলে থাকে। কিন্তু তারা জিহাদের সাথে অখণ্ডরূপে একাত্ম যেসব শর্তাবলী রয়েছে, সে বিষয়টি একেবারেই ভুলে যায়। এছাড়া আত্মঘাতী হামলা চালানো পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সব ধর্মই শান্তি চায়, নৈরাজ্য বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে ধর্মের সেবা হয় না। ধর্মের সেবা তখনই হয় যখন ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা হয়।
তাই আসুন না, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করে নিজ পরিবার, দেশ এবং বিশ্বকে শান্তির নীড়ে পরিণত করি।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট।