কুরআনের ১৩তম পারা দশম তারাবির পঠিতব্য অংশ। এতে রয়েছে সূরা ইউসুফের শেষার্ধ, সূরা রাদ ও সূরা ইবরাহিম।
ঘটনাবলি :
ত্রয়োদশ পারার শুরু থেকে ইউসুফ (আ.)-এর অবশিষ্ট ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যথা, ইউসুফ (আ.)-এর কারামুক্তি, মিশরের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন, দুর্ভিক্ষ, ত্রাণের জন্য সৎ ভাইদের মিশরে আগমন, ইউসুফ (আ.)-এর অপূর্ব ক্ষমা, পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর সপরিবারে মিশরে আগমন এবং ইউসুফ (আ.)-এর শৈশবে দেখা স্বপ্ন সত্যে পরিণত হওয়া ইত্যাদি। ১২/৫৩-১০০
ইবরাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর পক্ষ থেকে দুই সন্তান ইসমাইল ও ইসহাককে লাভ করেন। এরপরই আসে আল্লাহ প্রদত্ত কঠিন পরীক্ষা। স্ত্রী হাজার এবং নবজাতক ইসমাইলকে জনমানবশূন্য পাহাড়ি এলাকা মক্কায় রেখে আসেন তিনি। এমন কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তেও ইবরাহিম (আ.) সন্তানদের একত্ববাদ, সালাত কায়েম ও দীনদারি রক্ষার দোয়া করেন আল্লাহর নিকট। পাশাপাশি তাদের রিযিক, মক্কা নগরীর নিরাপত্তা এবং মক্কার প্রতি মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টির দোয়া করেন। ১৪/৩৫-৪০
ঈমান-আকীদা :
তাওহীদ কুরআনের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। তাওহীদ ফোনের ডিজিটের মতো। একটি সংখ্যা ভুল হলেই পুরো চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ কারণে কুরআনের অন্যসব পারার মতো আজকের তিলাওয়াতকৃত অংশেও যথারীতি বারবার ঘুরেফিরে তাওহীদের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তওহীদ ছাড়াও সূরা রাদের শুরুতে এবং পুরো সূরা জুড়ে আল্লাহর সৃষ্টিনৈপুণ্য ও সৃষ্টির নিগুঢ় রহস্য, ফেরেশতাদের আল্লাহভীতি, আসমানি কিতাব আল্লাহ প্রদত্ত ইত্যাদি বিষয় বারবার উঠে এসেছে। সূরা ইবরাহিমে কিয়ামতের প্রতি ঈমান বিষয়ক আলোচনা এবং সেদিনের ভয়াবহতার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে সূরার শেষে জাহান্নামের ভয়াবহ দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে।
আদেশ :
■ মানুষকে অন্ধকার (কুফুর) থেকে আলোর (ঈমান) পথে আনা এবং আল্লাহর দিনসমূহ (ঈমানজাগানিয়া ইতিহাস) স্মরণ করানো। ১৪/৫
■ আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করা। ১৪/৬
■ আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা। ১৪/১১
■ বিচার দিবস সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা। ১৪/৪৪
নিষেধ :
■ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। ১২/৮৭
■ জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহকে বেখবর মনে না করা। ১৪/৪২
■ আল্লাহকে রাসূলদের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গকারী মনে না করা। ১৪/৪৭
কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য :
কুরআর নাযিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসা। ১৪/১
শয়তান ও তার অনুসারীদের বচসা :
কিয়ামতের দিন শয়তান ও তার অনুসারীদের মধ্যকার কথোপকথন, পারস্পরিক দোষারোপের চিত্র, অবাধ্যদের ভুলের পরিণতি ও বেদনাদায়ক বাস্তবতার বর্ণনা রয়েছে সূরা ইবরাহিমে। সেদিন শয়তান তার অনুসারীদের বলবে, আমি স্রেফ তোমাদেরকে আমার পথে আহ্বান করেছিলাম, তোমরা তাতে সাড়া দিয়েছ। সুতরাং আজ আমাকে ভর্ৎসনা না করে নিজেদের ভর্ৎসনা করো। ১৪/২২
সব নবী-রাসূলকে স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করা হয়েছে :
আল্লাহ সকল নবী-রাসূলকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন, যেন তারা নিজ জাতিকে (আল্লাহর কিতাবসমূহ) স্পষ্ট করে বোঝাতে পারেন। ১৪/৪
আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ :
নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল, চন্দ্র-সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, রাতদিনের পালাবদল, রকমারি ফলমূল, একই মাটিতে উৎপন্ন বৃক্ষরাজির ফলন ও স্বাদের তারতম্যসহ অসংখ্য সুনিপুণ সৃষ্টিরাজি মহান আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। মহাবিশ্বের প্রতিটি নিখুঁত সৃষ্টিতে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান মানুষদের গবেষণার উপকরণ ও বহু নিদর্শন রয়েছে। ১৩/২৪
উলুল আলবাব ও জান্নাতীদের আটটি বৈশিষ্ট্য :
১. আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং চুক্তির বিপরীত কাজ করে না।
২. আল্লাহ যাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।
৩. আল্লাহকে ভয় করে।
৪. পরকালের কঠিন হিসাবকে ভয় করে।
৫. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবর করে।
৬. সালাত কায়েম করে।
৭. প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ হতে ব্যয় করে।
৮. ভালো দ্বারা মন্দের প্রতিরোধ করে। ১৩/২০-২২
পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকে এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট ঠিকানা (জাহান্নাম)। ১৩/২৫
সিজদার আয়াত :
সূরা রাদের ১৫ নম্বর আয়াতটি সিজদার আয়াত। এই আয়াত তিলাওয়াতের পর সিজদা করা ওয়াজিব।
আয়াতটির অর্থ হলো:
আল্লাহর প্রতি সিজদায় অবনত হয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল-সন্ধ্যায়। ১৩/১৫
নিয়ামত বৃদ্ধির মাধ্যম শুকরিয়া :
প্রাপ্ত নিয়ামতের ব্যাপারে অধিক হারে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ নিয়ামত আরো বৃদ্ধি করে দেন। আর অকৃতজ্ঞদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। ১৪/৭
দৃষ্টান্ত :
কাফিররা ভালো কাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই প্রাপ্ত হয়ে যায়। আখিরাতের তাদের কোনো অংশ নেই। আখিরাতে তাদের ভালো কাজের পরিণতি কেমন হবে, তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মহান আল্লাহ। তাদের ভালো কাজসমূহ ঝড়ের দিনে তীব্র বাতাসে উড়ন্ত ছাইয়ের মতো হয়ে যাবে। অর্থাৎ বাতাস যেমন ছাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, কুফুরও কাফিরদের আমলসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। অর্জিত কর্মের কোনো বিনিময় তারা লাভ করবে না। এটাই তাদের জীবনের চরম বিভ্রান্তি। ১৪/১৮
কালিমায়ে তাইয়্যিবাকে (পবিত্র কথা অর্থাৎ ঈমান ও তাওহীদ) আল্লাহ এমন গাছের সাথে তুলনা করেছেন, যার শেকড় অত্যন্ত মজবুত ও সুদৃঢ় এবং তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে আকাশে। আর কালিমায়ে খবিসাহকে (নোংরা কথা অর্থাৎ কুফর ও শিরক) তুলনা করেছেন এমন দুর্বল শেকড়-বিশিষ্ট গাছের সাথে, যা খুব সহজেই উপড়ে ফেলা যায়। ১৪/২৪-২৬
মহান আল্লাহ হক ও বাতিলের উপমা দিয়েছেন দুটি জিনিসের সাথে। বৃষ্টির পানিতে যখন নদী-নালা ভরে যায়, তখন বুদ্বুদ পানির ওপর ভেসে ওঠে এবং এক সময় তা বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে যখন অলংকার বা অন্য কোনো বস্তু তৈরির জন্য ধাতব পদার্থ আগুনে দেওয়া হয়, উত্তপ্ত আগুনের স্পর্শে তখনও তার ফেনা ভেসে ওঠে। অর্থাৎ, ফেনা শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু অলংকার বা পানি, যা মানুষের জন্য উপকারী, তা রয়ে যায়। একইভাবে বাতিলের প্রভাব যতই দৃশ্যমান হোক, তা মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। এক সময় তা বিলীন হবেই। কিন্তু হক ও সত্য মানবসভ্যতার জন্য চির-উপকারী, এ জন্য তা সর্বদা টিকে থাকে। ১৩/১৭
সুসংবাদ ও সতর্কতা :
ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদেরকে এমন উদ্যানরাজিতে (জান্নাত) প্রবেশ করানো হবে, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নহরসমূহ। জান্নাতীদের পারস্পরিক অভিবাদন হবে ‘সালাম’। ১৪/২৩
জালিমদের (কাফির ও সীমালঙ্ঘনকারী) জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ১৪/২২
সূরা ইবরাহিমের শেষ নয়টি আয়াতে কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ দৃশ্য, জাহান্নামীদের করুণ অবস্থা ও চরম দুর্গতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১৪/৪৪-৫২
যে আদেশ অধিক সংখ্যকবার করা হয়েছে :
আজকের তিলাওয়াতকৃত পারায় তিনটি পৃথক আয়াতে তিনবার কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১২/৬৭; ১৪/১১, ১২