৯ম তারাবীহতে পঠিতব্য অংশ হলো কুরআনের ১২তম পারা। এর মাঝে আছে সূরা হূদের অবিশিষ্ট অংশ ও সূরা ইউসুফের প্রথমার্ধ। সূরা হূদে মহাপ্রলয়, কিয়ামতের ভয়াবহতা ও জাহান্নামের শাস্তির লোমহর্ষক বিবরণ এসেছে। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সূরা হূদ আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে।[১]
ঘটনাবলি :
সূরা হূদের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন নবী-রাসূলের স্বজাতির অবাধ্যতার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
কুরআনে যেসব নবী-রাসূলের আলোচনা সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে, নূহ (আ.) তাদের একজন। স্বজাতিকে তিনি সাড়ে নয়শ বছর তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। তবু তারা দীন গ্রহণ করেনি। সমাজের গুরুত্বহীন লোকেরা নূহের (আ.) অনুসারী, তিনি মানুষ হয়েও রাসূল দাবি করেন—এইসব খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তারা নূহ (আ.)-এর দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করে। শুধু তাই নয়, ঔদ্ধত্যের চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে তারা আল্লাহর আযাব নাযিলের দাবি জানায়। মহান আল্লাহ নূহকে একটি বিশাল নৌকা নির্মাণের এবং মুমিনদেরকে নৌকায় তোলার নির্দেশ দেন। এরপর সর্বগ্রাসী বন্যায় কাফিরদের ধ্বংস করেন। ১১/২৫-৪৯
হূদ (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন আদ জাতির কাছে। স্বজাতিকে তিনি স্বার্থহীনভাবে একত্ববাদের পথে আহ্বান করেন। কিন্তু তারাও হঠকারিতা এবং ঔদ্ধত্যের পথ বেছে নেয়। ফলে আল্লাহর আযাব তাদেরকে ধ্বংস করে। ১১/৫০- ৬০
ছামূদ জাতিও অস্বীকার করে তাদের নবী সালেহ (আ.)-কে। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত উটনীকে তারা হত্যা করে। নাফরমানির কারণে তারাও আল্লাহর আযাবের শিকার হয়। ১১/৬১-৬৮
আল্লাহর কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় এবং কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না—এমন শিক্ষামূলক ঘটনার বিবরণ উঠে এসেছে সূরা হূদের মাঝামাঝি অংশে। বৃদ্ধ ইবরাহীম (আ.) ও তার স্ত্রীকে অবাক করে মহান আল্লাহ ইসহাক নামক সন্তানের সু-সংবাদ দিয়ে একদল ফেরেশতা প্রেরণ করেন। ১১/৬৯-৭৬
লূত (আ.)-এর সম্প্রদায় সমকামিতার মতো জঘন্য নোংরামী ও অপরাধের সূচনা করে। লূত (আ.) বহুভাবে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আপন অপকর্মে তারা অটল থাকে। সেই জনপদে মানুষের বেশে একদল আযাবের ফেরেশতা প্রেরণ করেন আল্লাহ। তারা লূত (আ.)-এর মেহমান হন। নরাধমরা ফেরেশতাদের সাথেও নোংরা কাজের দুঃসাহস দেখালে লূত (আ.) ভয় পেয়ে যান। ফেরেশতারা তাকে নিৰ্ভয় থাকতে বলেন এবং ঈমানদারদের নিয়ে এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে তারা পাপিষ্ঠদের ওপর প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং পুরো এলাকা উল্টে দেন (জর্ডানে অবস্থিত ডেড সি আজও সেই আযাবের সাক্ষী হয়ে আছে)। ১১/৭৭-৮৩ মাদায়েনবাসীর নিকট প্রেরিত শুআইব (আ.)-এর জাতি ব্যবসায় ভেজাল ও ওজনে ফাঁকি দিত। নবীর অবাধ্যতার কারণে তারাও আল্লাহর আযাবে (ভূমিকম্পে) ধ্বংস হয়। ১১/৮৪-৯৫
এরপর মূসা (আ.) ও ফিরাউনের ঘটনার চুম্বকাংশও বর্ণিত হয়েছে।
সূরা ইউসুফ বেশ বড় আয়তনের সূরা। সমগ্র সূরা জুড়ে বর্ণিত হয়েছে ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনাবহুল জীবনের আখ্যান। শৈশবে ইউসুফের (আ.) তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন, সৎ ভাইদের শত্রুতা, কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়া, পথিকদের মাধ্যমে উদ্ধার হয়ে মিশরের বাজারে বিক্রি হয়ে মিশরের রাজ পরিবারে অবস্থান, জুলাইখার নিষিদ্ধ আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কারণে অন্যায়ভাবে কারাবরণ, স্বপ্নের ব্যখ্যার মাধ্যমে মুক্তি, ভাইদের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ, প্রতিশোধবিহীন অপূর্ব ক্ষমা এবং সব শেষে পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে পুরো সূরা জুড়ে।
বহুমাত্রিক উপদেশ, শিক্ষা, চরিত্র হেফাজতের সংকল্পের বিরল দৃষ্টান্তসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকার কারণে এটিকে ‘আহসানাল কাসাস’ বা সর্বোত্তম ঘটনা বলেছেন আল্লাহ।
ঈমান-আকীদা :
ইসলামের মৌলিক কয়েকটি আকীদা-বিশ্বাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ হয়েছে সূরা হূদে। যেমন একত্ববাদ, তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি ঈমান তথা পুনরুত্থান । ১১/৬ ১৪, ২৬, ৫০, ৩৪
আদেশ :
■ ধৈর্য ধারণ করা। ১১/৪৯
■ আল্লাহর ইবাদত করা। ১১/৫০
■ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তাওবা করা। ১১/৫২
■ আল্লাহকে ভয় করা। ১১/৭৮
■ ওজন ও পরিমাপ ন্যয়সঙ্গতভাবে পূর্ণ করা। ১১/৮৫
■ আল্লাহর নির্দেশের ওপর অবিচল ও স্থির থাকা। ১১/১১২
■ দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে সালাত আদায় করা। ১১/১১৪
■ আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ১১/১২৩
নিষেধ :
■ (কুরআনের ব্যাপারে) সন্দেহে পতিত না হওয়া। ১১/১৭
■ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব না করা। ১১/২৬
■ কাফিরদের কার্যকলাপে বিমর্ষ না হওয়া। ১১/৩৬
■ কাফিরদের সাথে না থাকা। ১১/৪২
■ অপরাধী হয়ে আল্লাহ থেকে বিমুখ না হওয়া। ১১/৫২
■ ওজন ও পরিমাপে কম না দেওয়া। ১১/৮৪
■ পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলার বিস্তার না ঘটানো। ১১/৮৫
■ সীমালঙ্ঘন না করা। ১১/১১৩
■জালিম, পাপিষ্ঠদের প্রতি ধাবিত না হওয়া। ১১/১১৩
কিয়ামতের ভয়াবহতা :
কিয়ামতের ভয়াবতার কিঞ্চিত ইঙ্গিত রয়েছে সূরা হূদে। সেদিন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো কথা বলার সুযোগ থাকবে না। জাহান্নামীদের গগনবিদারী চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে। অবিশ্বাসীরা সেখানে চিরকাল থাকবে। ঈমানদার ও অনুগত বান্দারা জান্নাতের নিয়ামত চিরকাল ভোগ করবে। ১১/১০৫-১০৮
রিযিকের নিশ্চয়তা :
ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ন্যস্ত। সুতরাং, রিযিক আহরণের চেষ্টা করতে হবে ঠিক; কিন্তু রিযিকের বিষয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা ঈমানদারের জন্য শোভনীয় নয়। ১১/৬
দৃষ্টান্ত :
আল্লাহ মুমিন এবং কাফিরের উপমা দিয়েছেন অন্ধ-বধির আর চক্ষুষ্মান-শ্রবণকারীর সাথে। হক উদ্ঘাটন ও সত্য উপলব্ধি করতে না পারাকে অন্ধত্ব ও বধিরতার সাথে তুলনা করা হয়ছে। ১১/২৪
সুসংবাদ ও সতর্কতা :
যারা বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান। ১১/১১
যারা আল্লাহর বিষয়ে মিথ্যারোপ (আল্লাহর শানের পরিপন্থি বিশ্বাস ও উক্তি) করে তাদের চেয়ে বড় জালিম-পাপিষ্ঠ আর কে আছে! এই শ্রেণীর মানুষকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করা হলে সাক্ষীরা বলবেন, জালিমদের ওপর আল্লাহর লানত। ১১/১৮
যারা পার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য চায় (অথচ ঈমান না আনে) তাদের সেবা ও কল্যাণমূলক কাজের বিনিময় আল্লাহ দুনিয়াতেই দিবেন। আখিরাতে তারা কিছুই পাবে না; উপরন্তু তারা জাহান্নামে যাবে। এমনকি কোনো মুসলিমও যদি নাম-যশ বা পার্থিব স্বার্থের জন্য ভালো কাজ করে, সেও আল্লাহর কাছে সে কাজের কোনো বিনিময় পাবে না। পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনে, নেক আমল করে, বিনীত ও একাগ্রচিত্তে প্রতিপালকের সামনে নত হয়, তাদের জন্য জান্নাতের চিরস্থায়ী পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন মহান আল্লাহ। ১১/১৫-২৪
সূরা ইউসুফের কতিপয় শিক্ষা :
হিংসা জঘন্যতম কাজে প্ররোচিত করতে পারে। যার ফলে পরবর্তীতে অনেক লজ্জিত হতে হয়। যেমনটি ঘটেছে ইউসুফ (আ.)-এর ভাইদের বেলায়। তাই হিংসা পরিহার করা কর্তব্য। ১২/৮-১০
আকর্ষণ এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাপ ও অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা প্রকৃত বীরত্ব ও সাহসিকতার কাজ। তার জন্য চাই সর্বোচ্চ তাকওয়া এবং আল্লাহর ভয়। লোভ ও মোহ থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দেয় সূরা ইউসুফ। তারুণ্যকে অবৈধ সম্পর্ক থেকে পবিত্র রাখতে ইউসুফ (আ.)-এর প্রচেষ্টা উত্তম উদাহরণ ও প্রেরণা। ১২/২৩-৩৪
পাপ ও অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করা কর্তব্য। যেমন ইউসুফ (আ.) জুলাইখার কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে আত্মরক্ষার জন্য দৌড় দিয়েছিলেন। ১২/২৫
সত্য পথে থাকার পরও কখনো কখনো দুঃখ-কষ্ট এবং অপবাদ সহ্য করতে হয়। যেমন ইউসুফ (আ.) মিথ্যা অপবাদের শিকার হয়ে জেল পর্যন্ত খেটেছিলেন। ১২/৩৩
প্রবৃত্তি সর্বদা মন্দ কাজের নির্দেশ করে। সুতরাং সফলতার জন্য সতর্ক থাকা এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। ১২/৫৩
কোনো ভালো কাজের সুযোগ কিংবা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার তাওফীককে নিজের কৃতিত্ব মনে না করে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ মনে করা উচিত। ১২/৫৩
দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনের পর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতা আসে। যেমন ঘটেছিল ইয়াকুব ও ইউসুফ (আ.)-এর বেলায়। সবুর করলে বহুকাল পরে হলেও মেওয়া ফলে। প্রয়োজন শুধু আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে ধৈর্য ধারণ করা। ১২/৯৪, ১০০
ক্ষমা উন্নত মানসিকতার পরিচয়। প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমা অনেক বেশি উপভোগ্য । যেমন ইউসুফ (আ.) প্রতিশোধ না নিয়ে ভাইদের জঘন্য অপরাধও ক্ষমা করেছিলেন। ১২/৯২
[১] সুনানুত তিরমিযি, ৩২৯৭; শুআবুল ঈমান, ৭৫৬